DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

দীর্ঘ ৩ বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের সূরাহা হয়নিঃ সরকারের রাঘব বোয়ালদের জড়িত থাকার অভিযোগ

runiক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  তিন বছরেও সাগর-রুনির খুনিরা ধরা পড়েনি : মেঘের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।কেউ কথা রাখেনি,কেনো??? তিন বছরেও বিচার হলো না চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরন রুনি হত্যাকাণ্ডের। রাজধানীতে নিজ বাসার বেডরুমে দু’জন সিনিয়র সাংবাদিক নৃশংসভাবে খুন হওয়ার ঘটনা অনেকটা ধামাচাপা পড়ে গেছে।

জোড়া খুনের বিচারের দাবিতে শুরু থেকেই পরিবার ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোর তত্পরতায় হয়ে ওঠে। সরকার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের কথা বলেছিল। লাশ পুনরায় ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয়। মামলা ডিবি থেকে আদালতের নির্দেশে র্যাবে স্থানান্তর করা হয়। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। সাগর-রুনির খুনি সন্দেহে কয়েকজন পেশাদার খুনিকে আটকের কথাও বলেছিলেন তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখনও সাগর রুনি হত্যারহস্য এবং খুনি গ্রেফতার হয়নি বলে দাবি পরিবারের। আর বিচার না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন নিহতের পরিবার। পরিবার বলছে, হত্যা মামলাটি হিমাগারে পড়ে আছে। দিন যতো যাচ্ছে, বিচার পাওয়া নিয়েও সংশয় ততোটাই বাড়ছে।

মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে নৃশংসভাবে খুন হন।১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রাজাবাজারের ভাড়া বাসা থেকে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার ব্যাপারে মামলা হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায়। ১১ ফেব্রুয়ারি রাজাবাজারের ওই বাসায় ছুটে যান তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং র্যাবের ডিজিসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেক কর্তা।

runi1সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় আছে পুলিশ।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময়সীমা শেষে ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশ সদরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’ নিজের বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ডের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, যে কোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন। তদন্ত কাজে অগ্রগতি হয়েছে।

সেখানে তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কাজ যেন দ্রুত হয় সে জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ওই দিন আইজিপি বলেন, তদন্ত কাজ চলছে। ওই বছরই ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে। তদন্ত কার্যক্রম চালাতে সময় একটি আপেক্ষিক বিষয়। কিন্তু এখনও অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি।

১৬ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমি এখনই বলতে পারি। তবে তদন্তের স্বার্থে তা বলা ঠিক হবে না। এ হত্যাকাণ্ডে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকের ছোট ভাইয়ের নাম এসেছে এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে ২০টি বেনামি চিঠি ও অসংখ্য এসএমএস এসেছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি- তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আইনশৃঙ্খলা অবনতিসহ ঢাকায় সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত রয়েছে। অথচ এ বিষয়ে পুলিশের তদন্ত সংস্থা কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং বিশেষ সহকারী মিডিয়া মাহবুবুল আলম শাকিল দুই সাংবাদিকের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে গিয়ে এজন্য বিরোধীদলকে দোষারোপের ইঙ্গিত করে নানা মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ বিরোধীদলকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘সমাজে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, বিঘ্ন করতে চায় স্বাভাবিক সামাজিক জীবন তাদের দ্বারাই এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘এমন দুটি প্রাণ হারিয়ে যেতে পারে, তাদের হত্যা করা হতে পারে একথা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের পক্ষে কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সাগর-রুনি তাদের বাসায় বেডরুমে মারা গেছে। আমরা কী মানুষের বেডরুমে পুলিশ বসাতে পারব? তা তো পারব না। তবে এ হত্যা মামলার যথাযথ তদন্ত চলছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।

সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ এ, প্রশাসন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ডিআরইউ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি একথা বলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমকে রক্ষার জন্য সরকার ও গণমাধ্যম উভয়কে সম্মিলিতভাবে মিথ্যাচার, গুজব ও জঙ্গিবাদ প্রতিহত করতে হবে।

 

এদিকে তদন্ত কার্যক্রমে অগ্রগতি না হওয়ায় শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের পর ডিবির হাত ঘুরে র্যাবের হাতে যায় মামলাটি। সাগর-রুনির লাশ তুলে আবারও ময়নাতদন্ত করা হয়। র্যাব এ মামলা তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণের পর সাগর-রুনির ডিএনএ’র আলামত সংগ্রহ করে দেড় বছর আগে পরীক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠায়। কিন্তু হত্যারহস্য উন্মোচিত হয়নি। এদিকে দীর্ঘদিনে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা। এই পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

 

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘটা করে মিডিয়ায় এই গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে ব্রিফিং করেছিলেন, যার মধ্যে নিহতদের রাজাবাজারের বাসার দারোয়ান এনামুলও রয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া অন্য সাতজন হলেন তানভীর রহমান, বাড়ির অপর এক দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল, সন্দেহজনক ডাকাত রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও সাঈদ। এর মধ্যে তিনজন পেশাদার খুনি। যারা ডা. নিতাই হত্যা মামলার আসামি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে তদন্ত এই আটজন গ্রেফতার হওয়া পর্যন্তই থেমে আছে। গ্রেফতারকৃত কেউই হত্যার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেননি। দিতে পারেননি কোনো ক্লু। কাজেই র্যাবের এই গ্রেফতারকে অগ্রগতি হিসেবে দেখছে না নিহত সাগর-রুনির স্বজন ও গণমাধ্যম কর্মীরা।

 

সবকিছুর পরও স্বজন ও সহকর্মীদের দাবি একটাই, সাগর-রুনি হত্যার সুষ্ঠু বিচার। সেই সঙ্গে সবাই পেতে চান উত্তর, কেন ঘটেছিল এই হত্যাকাণ্ড? মেঘের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি : সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের বয়স এখন সাড়ে ৭ বছর। দু’বছর আগের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে মাহির সারওয়ার মেঘ এখন বড় হচ্ছে নানা-নানী আর মামাদের আদরে। তাদের সঙ্গে রাজাবাজারেই বাস করছে মেঘ। স্বজনরা জানান, ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি মেঘ। সে এখনও মাঝরাতে কেঁদে ওঠে। যদিও স্বজনরা চেষ্টা করেন সেই ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে মেঘ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠুক। এজন্য তারা চান না মেঘকে কেউ সেই রক্তাক্ত রাতের বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দিক।

তবুও মেঘ নিজে নিজেই হাতড়ে বেড়ায় সেই নির্মম স্মৃতি। মেঘের মামা নওশের রোমান জানান, মেঘ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। বেশি মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু যখন সে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে থাকে, তখন সঠিক নিয়মে খাবার খায়, স্কুলে যাওয়ার জন্য কোনো টালবাহানা করে না। পরীক্ষায়ও সে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে। তিনি বললেন, মেঘ এখন বুঝতে পারে তার বাবা-মা আর ফিরে আসবে না। তারা চলে গেছে না ফেরার দেশে। চোর তাদের মেরে ফেলেছে। সে এখন বুঝতে পারে তার বাবা-মাকে যারা মেরে ফেলেছে তাদের বিচার এখনও হচ্ছে না। তাই মনের মধ্যে একটা আশা বেঁধে আছে শিশুটির, যারা তার মা-বাবাকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে। আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে প্রতি রাতে। যেখানেই তারা আছে যেন ভাল থাকে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তাদের সাড়ে পাঁচ বছরের শিশুসন্তান মেঘের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অনেকে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তার দায়িত্ব নেয়ার। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের খুনিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার। ঘটনার দু’বছর পার হয়েছে। কেউ কোনো কথা রাখেনি। সাগর-রুনির হত্যারহস্য এখনও অন্ধকারেই রয়ে গেছে। স্বজনরা ছাড়া সাড়ে ৮ বছরের অসহায় মেঘের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।

 

এ প্রসঙ্গে নওশের রোমান বললেন, অনেকেই মেঘের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কেউ আর খোঁজ নেয়নি। আরও অনেকে অনেক আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাদের কেউ আর মেঘের পাশে দাঁড়াননি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!