DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

সেক্টর কমান্ডার এবং আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকারের শাস্তি, বই বাজেয়াপ্তের দাবী নিয়ে সংসদে তুমুল হইচই ও হট্টগোল

resize (1)‘১৯৭১: ভেতরে-বাইরে’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ এনে বইটির লেখক মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং   আওয়ামী সরকারের সদ্য সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী  এয়ার ভাইস মার্শাল(অবঃ)  এ কে খন্দকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এমপিরা। সরকার, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র এমপিদের পক্ষ থেকে সংসদে এ দাবি জানানো হয় ।

একই সঙ্গে তার লেখা বইটি বাজেয়াপ্তের দাবি জানান তারা। তারা বলেন, জাতিকে বিভ্রান্ত করতেই পরিকল্পিতভাবে এ কে খন্দকার বিকৃত ইতিহাস সংবলিত বইটি লিখেছেন। কারও প্ররোচনায় কিংবা পরাজিত শক্তির দোসর কোন এজেন্সির টাকা খেয়ে বঙ্গবঙ্গু হত্যার পর খুনি মোশ্‌তাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী এ কে খন্দকার এ ধরনের বই লিখে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কারও প্ররোচনায় কিংবা অন্য কোন নির্দেশে এ কে খন্দকার বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

তারা অবিলম্বে বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি এ ধরনের বিকৃত ইতিহাস সংবলিত বইটি ঘৃণাভরে  প্রত্যাখ্যান করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় স্পিকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সময় আমারও কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল। জাতির জনককে হত্যার পর খুনি মোশ্‌তাককে সমর্থনকারী তার বইতে কি লিখলো, তাতে জাতির কোন যায় আসে না। ৭ই মার্চ ভাষণ সম্পর্কে উনি যা লিখেছেন তা অবশ্যই জাতির সামনে অবমূল্যায়িত হবে। কেননা বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। 





ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের পর সংসদ অধিবেশন শুরু হলে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতর বাইরে’ বই নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত এই আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখক এ কে খন্দকারের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদল ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ। 





শিল্পমন্ত্রী আমির হোসনে আমু বিতর্কে অংশ নিয়ে বলেন, একাত্তর নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হয়। ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন এবং একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এ কে খন্দকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কাউকে ছোট করে কেউ বড় হতে পারে না। তারা বঙ্গবন্ধুকে টানাটানি করছেন না, তারা স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি করছেন। জাতির ওপর আঘাত করার জন্যই পরিকল্পিত এ ধরনের মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রগুলো কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়, পরাজিত শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। এই অপশক্তিই ১৫ই আগস্ট ঘটিয়েছিল, ২১শে আগস্ট ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করছে। এদের ব্যাপারে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 





 তোফায়েল আহমেদ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলেই শেষ করেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণের দিন আমরা মঞ্চেই ছিলাম। আমরা মঞ্চে থেকে জানলাম না, অথচ একে খন্দকার সাহেব তার লেখায় বললেন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য শেষে নাকি ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন! এটা উনি কোথায় পেলেন? ’৫২ সাল থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত এ কে খন্দকার পাকিস্তানে ছিলেন। এ দেশে কি হয়েছে তা তিনি জানতেন না। এই এ কে খন্দকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রেডিও স্টেশনে গিয়ে খুনি মোশ্‌তাককে সমর্থন দিয়েছিলেন। উনার (এ কে খন্দকার) লেখায় রয়েছে, আমাদের যুদ্ধের নাকি প্রস্তুতি ছিল না! তবে কি হাওয়ার ওপর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিকে পরিণত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধের সব নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় কোথায় থেকে অস্ত্র আসবে, নেতারা কোথায় থাকবেন- সেটিও আগেই বলে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। 





তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা না দিলে আগরতলা মামলা হতো না, মামলা না হলে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেতেন না, ’৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতো না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। মেজর সিদ্দিক সালেকের ‘উইটনেস অব সারেন্ডার’ বইটি পড়ার জন্য এ কে খন্দকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এসব লিখে অন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। এ কে খন্দকার কেন বইটি লিখেছেন, কোন সময়টা বেছে নিয়েছেন- তা আমি জানি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সবারই সতর্কতার সঙ্গে কথা বলা উচিত। 





 আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, কে কি লিখলো সেটা বাংলাদেশের ইতিহাস নয়। ২৫শে মার্চের পর বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কারও ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করেনি। ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ‘জয় পাকিস্তান’ কোথায় পেয়েছেন এ কে খন্দকারকে প্রমাণ করতে হবে। বিকৃত ইতিহাস কার স্বার্থে করা হচ্ছে? এদের ব্যাপারে দেশবাসীকে নতুন করে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোন প্রতিবাদ না করে খুনি মোশ্‌তাকের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেছেন। এরশাদেরও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এবার মন্ত্রী চলে যাওয়ায় ‘ব্যর্থ প্রেমিকের আর্তনাদ’ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বইয়ে। তিনি বলেন, একাত্তরে দু’ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এক পক্ষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, অপর পক্ষ পাকিস্তানের এজেন্ট হয়ে। এই ধরনের বিকৃত লেখা লিখে এ কে খন্দকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আইএসআই-এর টাকা খেয়ে লিখেছেন কিনা জানি না, কিন্তু কারও প্ররোচনায় কিংবা কোন এজেন্সির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে এ ধরনের লেখা তিনি লিখেছেন। অবিলম্বে এ কে খন্দকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিকৃত ইতিহাস সংবলিত তার লেখা বইটি বাজেয়াপ্ত করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 





 সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম বলেন, কোন মহলের প্ররোচনায় ইতিহাসের তথ্যগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করা হচ্ছে। আমি একাত্তরের ২৪শে মার্চ চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু করেছি। সেদিন জিয়াউর রহমান সেই যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশকে ১০ সেক্টরে ভাগ করা হয় ১০ই এপ্রিলে, তার আগে নয়। এ কে খন্দকার সাহেব বলেছেন, পাকিস্তানিরা নাকি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কখনওই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। তিনি সব সরকারের আমলে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তিনিও প্রশ্ন রেখে বলেন, হঠাৎ করেই কিভাবে এ কে খন্দকার ৭ই মার্চের ভাষণে কোথায় পেলেন ‘জয় পাকিস্তান’? এতদিন না বলে এখন কেন বলছেন, এর পেছনে রহস্য রয়েছে। আমি তাঁর এই লেখার নিন্দা করি। আমরা সবার আগে যুদ্ধ করেছি রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে। কোন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়নি, হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পৃথিবীর কোন দেশ জনগণের সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীন হয়নি, বাংলাদেশও নয়। কারও প্ররোচনায় কিংবা অন্য কোন নির্দেশে এ কে খন্দকার বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই, এ ধরনের বিকৃত ইতিহাস সংবলিত বইটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করুন। 





 জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, যিনি জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ছিলেন, মাত্র ক’দিন আগে আওয়ামী লীগেরও মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা খুনি মোশ্‌তাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাদের একজন এ কে খন্দকার সাহেব। স্বাধীনতার এত বছর পর তিনি মিথ্যা ইতিহাস লিখে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। ‘জয় পাকিস্তান’ উনি কোথায় পেলেন? এ সমস্ত কুলাঙ্গাররা বিকৃত বই লিখে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। 





 এ কে খন্দকারের কঠোর সমালোচনা করে জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, বাংলাদেশে প্রবাদ আছে বাংলাদেশে উপকার করলে গালি খেতে হয়। উনি সমস্ত সুবিধা নিলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী থাকাকালে কোন ফোরামে এ ব্যাপারে সামান্য কথা বলেননি কেন? সংবিধান লংঘন করা যদি অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধ করেছেন এ কে খন্দকার। এ ধরনের অপরাধ তার পক্ষ থেকে বাঞ্ছনীয় নয়। তিন হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি কখনওই স্বাধীন ছিল না। অতিরিক্ত বয়সে মানুষের সমস্যা হয়। যারা বই লেখেন কেউই সংবিধান লঙ্ঘন করবেন না, করলে জাতি ক্ষমা করবে না। 





 আলোচনার সূত্রপাত করে সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এ কে খন্দকার যে তথ্য দিয়েছেন তার বেশির ভাগই সঠিক হলেও বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্যও রয়েছে। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বলেই বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। এটা সবাই জানে। এই ইতিহাস যারা বিকৃত করতে চায়, তাদের ধিক্কার জানাই।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!