DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

বাংলাদেশের গুম-খুনের ব্যাপক প্রচলন করেছে র‍্যাবঃএই দানব এখনই বিলুপ্ত করা অতীব প্রয়োজনঃ গুম প্রতিরোধ দিবসে বিশিষ্ট জনদের মতামত

8aa6ccdf711f531699ce6dfee21ebacb-23-300x225দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ ‘আমাদের প্রত্যেকটা সকাল হয় অপেক্ষা নিয়ে। এই বুঝি আরিয়ানের বাবার একটা খবর পাব। কিন্তু দিন শেষে কিছুই হয় না। আমরা শুধু ওকে ফেরত চাই।’

মুখে ওড়নাচাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিলেন শাম্মী সুলতানা। তাঁর স্বামী রাজধানীর ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি খালিদ হাসান (সোহেল) গত বছরের ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে নিখোঁজ হন। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছে পরিবার।

শাম্মী সুলতানা যখন মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর ছয় বছরের ছেলে সাদমান শিহাব আরিয়ান দর্শক সারিতে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, বুকের কাছে ধরে আছে বাবার ছবি। ছবিতে আরিয়ানের বাবার হাসি হাসি মুখ। কিন্তু আরিয়ানের মুখ অন্ধকার, মলিন। শিশুটিকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ছবির লোকটা তার বাবা, যাঁকে আরিয়ান অনেক দিন ধরেই খুঁজে পাচ্ছে না। মা শাম্মী সুলতানার সঙ্গে এই ছবি নিয়ে নয় মাস ধরে বাবাকে খুঁজে ফিরছে আরিয়ান।

স্বজন হারানোর কষ্ট সবাইকে জানাতে গতকাল শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জড়ো হয়েছিল এক শর মতো পরিবার। তাঁরা কাঁদলেন, কাঁদালেনও। গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আর্তি জানানোর পাশাপাশি অপরাধীদের বিচারেরও দাবি করেন তাঁরা। স্বজনেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবকে এসব গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী করেছেন। এই দেশে বিচার না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তাঁরা।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস, ২০১৪ উপলক্ষে ‘স্বজনদের ব্যথা—গুম, খুন ও নির্যাতন আর না’ শিরোনামে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করে ‘মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি’ নামের একটি সংগঠন। বাংলাদেশে এ ধরনের অনুষ্ঠান এটাই প্রথম। আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সুশীল সমাজের কিছু মানুষের প্রতিবাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম এই সুরক্ষা কমিটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খানের সঞ্চালনায় সম্মেলনে গুম ও কথিত ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার ২৪ জনের স্বজন বক্তব্য দেন। একেক জন মঞ্চে বক্তব্য দিতে উঠে হু হু করে কাঁদছিলেন। আর তা সংক্রমিত হচ্ছিল উপস্থিত সবার মধ্যে।

গতকাল সকালে প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ঢোকার মুখেই দেখা গেল সারি সারি ব্যানার। সেগুলোতে মানুষের মুখ। ছবি হয়ে ঝুলছেন লাকসামের সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম (হিরু) ও তাঁর সঙ্গে গুম হওয়া হুমায়ুন কবীর পারভেজ, রাজধানীর শাহীনবাগের সাজেদুল ইসলাম (সুমন), কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের নেতা আল মুকাদ্দাসসহ অনেকেই, যাঁদের স্বজনেরা এখনো তাঁদের ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মিলনায়তনে ঢুকতেই দেখা হলো পঞ্চাশোর্ধ্ব শামসুদ্দীনের সঙ্গে। গলায় ঝুলছে একটি বড় ছবি, নিচে লেখা ‘নিজাম উদ্দিন মুন্নার পরিবারবর্গ’। এটাই তাঁর পরিচয়পত্র। ছবিটা শামসুদ্দীনের ছেলে ছাত্রদলের বিমানবন্দর থানার যুগ্ম সম্পাদক নিজাম উদ্দিনের, যিনি গত বছরের ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। শামসুদ্দীনের মতোই সম্মেলনে অংশ নেওয়া সবার গলাতেই ঝুলছিল নিখোঁজ হওয়া স্বজনের ছবিসংবলিত পরিচয়পত্র। বক্তব্যে শামসুদ্দীন বলেন, ‘আমার ছেলেকে যদি মেরে ফেলা হয়ে থাকে, কোথায় পুঁতে রেখেছেন বলেন, আমি জিয়ারত করতে যাব।’

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অনুষ্ঠান শুরুর পরই বক্তব্য দেন হাফেজ মেহেদী হাসান। তাঁর ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ব্যবসায়ী শাহনুর আলম (৪৩) র্যাবের নির্যাতনে মারা গেছেন। এ অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আদালতে মামলা করেছেন। মেহেদীর অভিযোগ, এখন তাঁকে গাড়িচাপা দিয়ে রাস্তায় মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এখন একা চলতেও ভয় পান তিনি।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকার আটজনকে ধরে নিয়ে যান র্যাব পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। এর পর থেকে তাঁরা উধাও। একজন ছাড়া অন্যরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পরিবারগুলোকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। চুপ থেকেও ছেলেদের ফেরত পায়নি পরিবারগুলো। এঁদের একজন এ এম আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন মাস্টার সম্মেলনে বলেন, ‘কালো পোশাক পরা র্যাবের লোক আমার ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেল। অথচ এখন র্যাব বলছে, আমার ছেলের কোনো খোঁজ তারা জানে না। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? ঢাকা মেডিকেল থেকে একটা বাচ্চা চুরি হওয়ার পর র্যাব উদ্ধার করে দিল। আর আমাদের আটটা ছেলের খোঁজ মিলছে না।’

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গুম হন সেলিম রেজা (পিন্টু)। তাঁর বোন রেহানা বানু কান্নার চোটে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। তিনি যখন বলছিলেন, ‘আমার মা-বাবা সব সময় অপেক্ষা করেন কখন পিন্টু এসে বলবে, দরজা খোলো।’ তখন মিলনায়তনে অনেককে চোখ মুছতে দেখা যায়।

গুমের শিকার ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা শামীম আক্তারের স্ত্রী ঝর্ণা খানম বলেন, ‘গুম হওয়া লোকগুলোকে যে অবস্থাতেই হোক আমাদের ফিরিয়ে দিন। না হলে আমাদেরও গুম করুন।’

চলতি বছরের মার্চে রাজধানীর কদমতলীতে র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন সংগ্রাম চৌধুরী ও ওয়াসিম নামের দুজন। সংগ্রামের ভাই প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘শত শত লোকের সামনে সংগ্রামকে ধরে নিয়ে একটি বাড়ির সিঁড়ির নিচতলায় নিয়ে গুলি করেছে র‍্যাব। ময়নাতদন্তে তাঁর শরীরে ১২টি গুলি পাওয়া গেছে। ভাইকে মেরে ফেলে র‍্যাব আমাদের চাপ দেয় লাশটি অতি দ্রুত দাফন করে ফেলার জন্য। ভয়ে আমরা রাতেই লাশ দাফন করি। মামলাও করতে পারিনি। আমাদের বলা হয়েছে মামলা করলে পরিবারের একজনকেও বাঁচতে দেবে না। আমরা হয়তো অচিরেই একই ঘটনার শিকার হতে পারি।’

পাঁচ বছর আগে গুম হওয়া বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘বাবার লাশটাও আমরা পাইনি। বাবা নিখোঁজের পরে কত ঈদ, পার্বণ চলে যায়। আমাদের পরিবারে কোনো আনন্দ হয় না।’

২০১২ সালের নভেম্বরে সাভারের নবীনগর থেকে গুম হয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা আল মুকাদ্দাসসহ দুজন। মুকাদ্দাসের বাবা আবদুল হালিমও ছেলেকে ফেরত চান।

বক্তাদের সবাই স্বজনদের ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বলেন, প্রধানমন্ত্রীও স্বজনহারা। তিনি স্বজনহারাদের ব্যথা বোঝেন।সম্মেলনে সাংবাদিক পুলক ঘটক সম্প্রতি দুই সাংবাদিক মিজান চৌধুরী ও দর্পণ কবীরকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান।

আপনাদেরও খাবে: সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য দেন মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে বলেন, ‘র‍্যাব যদি থাকে, আর আপনারা যদি ক্ষমতায় না থাকেন, তাহলে এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আপনাদের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়বে। ২০০৬ সালে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, “খালেদা জিয়া, আপনাদের এই র‍্যাব একদিন দানব হবে।” এখন খালেদা জিয়া সে বিষয়টি উপলব্ধি করছেন। আপনারা এখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। গুমের বিচার এ দেশে না হলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব। প্রতিটি গুমের বিচার হতেই হবে। না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না। এটা আমাদের দেশ। এই দেশে এভাবে মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে, আর সবাই কান্নাকাটি করবে, এটা হবে না।’

এ বক্তব্যের সময় মঞ্চে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, জাফরউল্লাহ চৌধুরী, আসিফ নজরুল, মাহমুদুর রহমান মান্না, খুশী কবির, শিরীন হক, সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের খালেকুজ্জামান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যায়ে সবার পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার অধিকার সংবিধানের ১ নম্বর অধিকার। আমরা নাগরিক হিসেবে অসহায় নই। আজ যেটা করেছি, আমরা সেটাই করতে পারি, সোচ্চার হতে পারি। আজ ভয় ভেঙে সবাই এখানে এসেছেন। এই ভয় ভাঙাটাকে সুসংহত করতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!