DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সহায়তা না পেয়ে ক্ষুদ্ধ নিহতদের পরিবার: হেফাজতের অনুদানের বিপুল অর্থ কোথায়?

image_89518_0২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অপারেশনের আগে-পরে হেফাজতে ইসলামের নামে প্রচুর অনুদান সংগৃহীত হয়েছে। প্রগতিবিরোধী ১৩ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৫ মে সংগঠিত অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব আর্থিক সহায়তা আসে।

কওমি মাদরাসার প্রবাসী ছাত্র-শিক্ষক, ধর্মভিত্তিক দলের নেতাকর্মীরা ব্যাংকে, হাতে-হাতে এই বিপুল পরিমাণ টাকা প্রদান করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্র চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদরাসায়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও এসব অর্থের সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব দিতে পারেনি হেফাজত কিংবা হাটহাজারী মাদরাসা।

তবে ৫ মে’র ক্ষতিগ্রস্তদের নামে অনুদান সংগ্রহ করা হলেও অনেক নিহতের পরিবার এসবের কিছুই জানে না। বাংলামেইলের অনুসন্ধানে এমন দু’টি পরিবারের সন্ধান বেরিয়ে এসেছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, হেফাজতের এসব অনুদান ও সহায়তার বিষয়ে তারা অজ্ঞাত। তবে এসব বিষয় জানতে পেরে বাংলামেইলের কাছে প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। তাদের ভাষ্য, আমাদের নামে অনুদান এলে আমরা পাবো না কেন? যদিও হেফাজতের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা এসব অর্থের ব্যয় নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি।

জানা গেছে, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন থেকে বেশিরভাগ অনুদান এসেছে সরাসরি হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর কাছে। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তিনি বিশাল অট্টালিকাও নির্মাণ করছেন।

হেফাজতের শরিক একটি দলের শীর্ষ এক নেতা দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে   জানান, লন্ডনে প্রবাসী জমিয়ত নেতা মাওলানা শোয়াইব আহমদের নেতৃত্বে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি নিহতের পরিবারের জন্য ১ হাজার পাউন্ড (১ লাখ ৩০ হাজার প্রায়) ও আহতের জন্য ৭শ পাউন্ড (প্রায় ৯০ হাজার টাকা) করে অনুদান সংগ্রহ করেন। অর্থ সংগ্রহ করে আনাসের কাছে অনুদান দিয়েছেন কুয়েত খেলাফত মজলিসের আমিরও।

হেফাজতের এক নেতা জানান, আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় কোটি কোটি টাকা এসেছে নামে-বেনামে। এসব অর্থ পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন মাওলানা আনাসসহ ওই মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক। ওই নেতার দাবি, ৫ মে পর কয়েকজন নেতার উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। কেউ ফ্ল্যাট কিনেছেন। কেউ সারা মাসই গাড়ি ভাড়া করে চলেন। স্বয়ং আনাস বাড়ি করছেন অর্ধকোটি টাকা ব্যায়ে।
 
অনুদানবঞ্চিত স্বজনরা
জানা গেছে, এসব অনুদান সংগ্রহ করা হলেও ৫ মে নিহতরা কোনো সাহায্য পায়নি। সহযোগিতা পাননি শাপলা চত্বরে নিহত কাজী রাকিবউদ্দীনের পরিবার। তার স্ত্রী সালমা হক আমাদের  জানান, হেফাজতের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগই করা হয়নি, অর্থ দেয়া তো দূরের কথা।

কাজী রাকিব উদ্দীন আজকে বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৪৪ বছর ২ মাস ৩ দিন। বেডিং-ব্যবসায়ী রাকিব বসবাস করতেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলার ভাঙা প্রেস বাসস্ট্যান্ডের পাশে। প্রতিদিনের মতো দুপুরে দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় এসে স্ত্রী সালমা আর দুই ছেলে কাজী ইবাদ ও কাজী রূপাইয়ের সঙ্গে খাবার খেতেন। কিন্তু গত এক বছর ধরে তিনি বাসায় আসেন না। তার ছবি দেখে ছেলে রূপাই সবাইকে বলে, বাবা মসজিদে গেছে। ততক্ষণে চোখের পানিতে ভাসছে সালমা হকের গাল।

গত রোববার দুপুর দেড়টার দিকে ভাঙা প্রেস এলাকার ছামাদনগর আবাসিক প্রকল্পের একটি একতলা বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল সালমা হকের সঙ্গে। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে কাজলায় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ায় কর্মরত মাওলানা আশরাফ ছামাদনগরে কাজী রাকিব উদ্দীনের বাসার সন্ধান দেন। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট করে বাড়ির ঠিকানা দিতে পারেননি। রিকশা নিয়ে ছামাদনগরে গিয়ে কাজী রাকিবের বাসা সন্ধান করলেও কেউ চিনে না বলেই জানান। এরপর এ প্রতিবেদকের সাহায্যে এগিয়ে আসে ১২ বছরের ইমন। বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করলেও সেদিন ইমন অনেকটা সময় দেয় এ প্রতিবেদককে। ছামাদনগরের নতুন গড়ে ওঠা প্রকল্পের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায় কাজী রাকিবের বাসায়। পরিচয় পেয়ে ঘরে ডেকে নেন সালমা হক। এরপর শরবতের মেহমানদারি।

কথায় কথায় সালমা হক বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে বিকেল ৩টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন কাজী রাকিব। তিনি কোনো দল করতেন না। তবে নামাজী ছিলেন। ওইদিন তার সঙ্গে শেষ কথা হয় রাত ৮টা ৪০ মিনিটে। কথা বলা অবস্থাতেই তিনি নীরব হয়ে যান।’

সালমা আরো বলেন, ‘তিনি আমাকে বলছিলেন, শাপলা চত্বরে কী জানি ঝামেলা হচ্ছে। আমি বললাম বাসায় আসেন। তিনিও বললেন আসতেছি। এরপর আর কোনো কথা নেই। শুধু গুলির আওয়াজ কানে আসছিল।’

কিন্তু আপনার স্বামী কোনো দল না করেও কেন শাপলা চত্বরে গিয়েছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না কোনো দল জীবনেও তিনি করেননি। শুক্রবার সকাল থেকে টিভিতে দেখছিলেন, বলছিলেন হেফাজতের সমাবেশ অনেক মানুষ হবে, আমি যাবো।’

সালমা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আসলে মরণ তারে ডাকছিল, তিনি চলে গেছেন। তা না হলে আমি এতো বার মানা করা সত্ত্বেও তিনি কেন গেলেন?’

কথায় কথায় ওঠে আসে তার দিনযাপনের বিষয়। জানান, তার মেঝ ভাসুর সহযোগিতা করেন। তিনি নিজে টিউশনি করেন। এভাবে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু বাড়িটি- সালমা উত্তরে বলেন, ‘এটি আমার শাশুরীর করা বাড়ি। আমি আর আমার জা একসঙ্গে থাকি। তার স্বামীও ১০ বছর আগে মারা গেছেন।’

কিন্তু আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর কেউ কি যোগাযোগ করেছিল- এমন প্রশ্নে সালমা হক সোজা উত্তর কষেণ, ‘না, কেউ না। না হেফাজত, না সরকার। অধিকার দুই বার আসছিল সার্ভে করতে। উত্তর দেয়ার পর চলে গেছে।’

কিন্তু হেফাজতের সমাবেশে তো আপনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে- সালমা হক বলেন, ‘হলে কী? হেফাজত কোনো সাহায্য করেনি। এমনকী একবারের জন্য ফোনও করেনি আমাকে।’

আপনি কী হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন- তিনি বলেন, ‘না, কেমনে করবো, আমি তো তাদের চিনি না।’ তার বাসার পাশেই হেফাজতের সমর্থক বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা বোর্ডের (বেফাক) কার্যালয়। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকেও কাজী রাকিব উদ্দীনের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।

গত বছর ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিরেন নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া (বকুলতলা) গ্রামের মাহমুদুল হাসান জুবায়ের (২০)। তিনি মাধবদী দরগাবাড়ী হাফিজিয়া আজিজিয়া মাদরাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তারা দুই ভাই, তিন বোন। তিনি সবার ছোট। গত বছর ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন জুবায়ের। পার হয়ে গেল একটি বছর। এ পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা পায়নি তার পরিবার।  

তার বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, জুবায়ের মারা যাওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের কোনো নেতাকর্মী আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে একদিন তিন-চার জন লোক এসে তাদের খোঁজ খবর নিয়েছে। যারা যোগাযোগ করেছে তারাও কোনো সহযোগিতা করেনি।

জোবায়েরের বাবা আব্দুল বাছেদ বলেন, ‘আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নাই, আল্লাহ আমার ছেলেরে নিয়ে গেছে। আর কারো কাছ থেকে কোনো অনুদান বা টাকা পাইনি।’

এদিকে নিহতদের পরিবারের মতো আহতরাও কোনো সাহায্য পায়নি। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেও চট্টগ্রাম থেকে কোনো খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। তবে আহত-নিহতদের খোঁজ-খবর না নিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ কাজে আগের মতো ব্যস্তই আছেন। কেউ আবার বড় বড় পার্টি করে লিখিত গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব করেছেন। কেউ আবার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াচ্ছেন।

প্রশ্ন ওঠেছে ঢাকা কমিটির অনুদান নিয়েও
রাজধানী ঢাকায়ও অনুদান সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। কমিটি সূত্র জানায়, ঢাকার ফান্ড বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা অদ্যাবধি দেননি হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর এবং ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক নূর হোসাইন কাসেমী। কত টাকা জমা আছে, কত ব্যয় হয়েছে- এসব বিষয় নিয়ে তিনি আজ পর্যন্ত কমিটির বৈঠকও ডাকেননি। উল্টো ফান্ডের টাকা দিয়ে নিজ দলের মহাসচিব মুহাম্মদ ওয়াক্কাছের চিকিৎসা, কারাগারের খরচ যোগানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

খেলাফত মজলিস ও খেলাফতে ইসলামী সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতের নেতা মামুনুল হক ও সাখাওয়াত হোসাইন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেও তাদের আইনী খরচ থেকে শুরু করে কোনো ব্যয়ই হেফাজতের ফান্ড থেকে দেয়া হয়নি। অথচ ফান্ডের নামে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন নগর কমিটির সদস্য জুনায়েদ আল হাবিব। গত বছরের ৫ মে’র পর একাধিকবার লন্ডন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তিনি অনেক অর্থ সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘হেফাজতের নূর হোসাইন কাসেমী ও জুনায়েদ আল হাবিব কোথাও থেকে কোনো টাকা গ্রহণ করেননি। হেফাজতের নামে কেউ অনুদান দিয়ে থাকলে সেটি কাসেমী সাহেবের কাছে নোট করা আছে। টাকা আত্মসাতের বিষয়ে যারা বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রচার করছে তারা হেফাজতের বিরুদ্ধে বলতে চাইছে। তারা হেফাজতের ক্ষতি চায়।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!