DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

৪ বছরে নিহত ৫০০জনঃ গণপিটুনিতে মানুষ মারার বিচার নেই!

image_84821_0দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ গত সোমবার, রাজশাহীর রানী বাজার এলাকা। একটা ছোট জটলা তার মধ্য থেকে ভেসে আসছে আর্তচিৎকার। একটু পরেই নিস্তব্ধ! ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখা গেল রক্তাক্ত এক যুবকের দেহ অসাড় পড়ে রয়েছে। পরে জানা গেল- লোকটি অটোরিকশাচালক সুইট হোসেন। অসাবধানতাবশত একটা রিক্শাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। তাতে রিকশাচালক সামান্য আঘাত পান। আর এতেই হুজুগে লোকেরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
 
এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন মঙ্গলবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকরা রাজশাহীতে বিক্ষোভ করেন। তবে সুইটের খুনিরা এখনো শনাক্ত হয়নি। যোগাযোগ করা হলে বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
 
২৪ মার্চ রাজধানীতে ঘটে এমন একটি ঘটনা। উত্তরখানে চোর সন্দেহে রহম আলী (৩৮) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় দোকান মালিক ও কর্মচারীরা। নিহতের ভাতিজা মোহাম্মদ বাবু বলেন, ‘রাতে একজনের ফোন পেয়ে তার চাচা বাড়ির বাইরে বের হন। তারপরই শুনতে পান তাকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। তিনি কখনই চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’
 
উত্তরখান থানার উপ-পরিদর্শক (এএসআই) কামাল উদ্দিন বলেন, ‘তালতলা কলেজ রোডের মা টেলিকম মালিকের নেতৃত্বে আরও কয়েকটি দোকানের মালিক মিলে চোর সন্দেহে রহম আলীকে পিটিয়ে আহত করেন। এ ঘটনাটি আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
 
এবার ফিরে দেখা যাক তিন বছর আগের আরেকটি আলোচিত ঘটনা। ২০১১ সালের ২৭ জুলাই ঘটনাটি ঘটে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। চরকাঁকড়া টেকারবাজার এলাকায় শামছুদ্দিন মিলন নামে এক তরুণকে ‘ডাকাত’ আখ্যা দিয়ে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। এ আলোচিত ঘটনায় তখন ওসিসহ চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু দায়িত্বে অবহেলায় অভিযুক্তরা এখন স্বপদে বহাল আছেন। তিন বছর পরও মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মিলনের পরিবারের অভিযোগ, মামলা থেকে পুলিশ সদস্যদের বাদ দিতেই অভিযোগপত্র দিতে বিলম্ব করা হচ্ছে। 
 
এছাড়া, গত কয়েক বছরের দেশের বিভিন্ন স্থানে রাতে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তার কোনোটিরই বিচার হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসেনি।
 
উপরে বর্ণিত ঘটনা তিনটির মতোই অবস্থা বেশিরভাগ গনপিটুনির মামলার। গণপিটুনিতে মৃত্যু হলে কার্যত কোনো তদন্ত হয় না। আর বিনা অপরাধে হত্যার অভিযোগ উঠলে তদন্ত যা হয়, তার চিত্রও ভয়াবহ। অভিযোগ না পাওয়া গেলে ‘অপবাদ’ সহ্য করে বিচারের আশা ছাড়তে হচ্ছে নিহতের স্বজনদের।
 
মানবাধিকার ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের প্রতি অনাস্থার কারণে আইন হাতে তুলে নেয়া বা গনপিটুনির ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এসব ঘটনার যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না। প্রতিদিনই দেশে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। 
 
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্যমতে, গত চার বছরে প্রায় ৫শ’ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। ২০১০ সালে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছে ১৬৭ জন। ২০১১ সালে নিহত হয়েছে ১৪৫ জন। ২০১২ সালে নিহত হয়েছে ৯৯ জন। ২০১৩ সালে নিহত হয়েছেন ৯৩ জন। 
 
সংস্থাটির তথ্য ও যোগাযোগ কর্মকর্তা পারভিন আক্তার বলেন, ‘১২টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে গণপিটুনির এ তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। এসব ঘটনার মধ্যে বিনা অপরাধে গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তবে সেগুলো আলাদা করা হয়নি।’
 
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এএসএম শাহজাহান বাংলামেইলকে বলেন, ‘একজন লোক খারাপ হলেও তাকে গণপিটুনি দিয়ে মারা যাবে না। এটা অসাংবিধানিক। আবার গণপিটুনিতে ভালো লোকও মারা যাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হওয়া জরুরি। দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় বলা আছে, কাউকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলে তা খুন হিসেবে গণ্য হবে। এর শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।’ 
 
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, ‘অনেক সময় মনে হচ্ছে পুলিশ গণপিটুনিকে এক ধরনের আইনি বৈধতা দিচ্ছে। গণপিটুনি হলে যেন পুলিশের কোনও দায়দায়িত্ব নেই। বিনা বিচারে কাউকে মারা অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইন কেউ হাতে তুলে নিতে পারে না।’  
 
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার (এসএস, সংঘবদ্ধ অপরাধ) আশরাফুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণহীন জনগোষ্ঠী আক্রমণ করলে আমরা গণপিটুনি বলি। আইনের বিশ্লেষণে সবই হত্যা। পুলিশ অন্য হত্যাকাণ্ডের মতোই গণপিটুনির তদন্ত করে। অপরাধীরা গণপিটুনিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করলেও তা তদন্তে বের হয়ে আসবে।’ 
 
জানা গেছে, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারে এসকে টাওয়ারের নিচে আবদুল্লাহ মাসুদ মুন্না নামে রামপুরার এক যুবককে ছিনতাইকারী বলে পিটিয়ে হত্যা করে কয়েকজন। এ ঘটনায় নিরাপত্তারক্ষী হাসানসহ দশ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে হামলার নেতৃত্বদানকারী চিত্রপরিচালক ওয়াজেদ সুমনকে (শাহীন-সুমন যুগলের সুমন) এখনো গ্রেপ্তার করেনি। তিনি প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করছেন।
 
হত্যা মামলার বাদী নিহতের বাবা এএইচএম খোরশেদ আলম জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মুন্নার সম্প্রতি দুই নবজাতক যমজ সন্তান মারা যায়। এরপর স্বামীকেও হারিয়ে মুন্নার স্ত্রী এখন পাগলপ্রায়।
 
পুলিশ ও প্রতক্ষদর্শীরা জানায়, এসকে টাওয়ারের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় মুন্নার গায়ে ধাক্কা লেগে একটি মোটরসাইকেল পরিচালক ওয়াজেদ সুমনের প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে। এসময় সুমনের নেতৃত্বে ৮/১০ জন মুন্নাকে ভবনের নীচতলায় নিয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করে। মুন্না নিহত হলে তাকে ছিনতাইকারী বলে গণধোলাইয়ে মারা গেছে বলে প্রচার করা হয়। 
 
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই কাজী শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘তুচ্ছ কারণে পিটিয়ে হত্যায় পরিচালক সুমন ও নিরাপত্তা কর্মী হাসান নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সুমনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ 
 
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর পল্লবীর সুজাতনগর বালুর মাঠে সবুজ নামে এক গামের্ন্টস কর্মীকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। পল্লবী থানার এসআই কামরুজ্জামান বলেন, ‘সবুজকে ছিনতাইকারী বলে পিটেয়ে হত্যা করে স্থানীয় কিছু লোক। পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই তিনি খুন হতে পারেন। জড়িতদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।’
 
সবুজের স্ত্রী লাইজু বেগম জানানা, তার স্বামী গার্মেন্টসে কাজ করতেনক। কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
 
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় কলেজছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গত ১৩ জুন তদন্ত শেষে আমরা মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করি। অভিযোগপত্রে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এখন মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন।’ 
 
সংশ্লিষ্টরা জানান, বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্র বেড়াতে যায়। একদল গ্রামবাসীকে উসকে দেয় মাদক ব্যবসায়ী চক্র। তারা নিরস্ত্র ছাত্রদের অমানবিকভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশের ভুমিকাও ছিল রহস্যজনক। 
 
২০১০ সালের ৬ নভেম্বর রাতে রাজধানীর শ্যামপুর-কদমতলী এলাকায় ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করে এলাকাবাসী। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, ডাকাত আখ্যা দিয়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ তদন্ত করে কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তা উদঘাটন করেনি। এ ঘটনার ব্যাপারে শ্যামপুর থানার পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দুই থানার সীমান্ত এলাকার খানকাশরীফ এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। কদমতলী থানায় মামলা হয়। চার মাসের মধ্যেই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট হয়েছে। নিহতরা ভালো মানুষ বলে কেউ দাবি করেনি।’
 
এদিকে নোয়াখালীতে মিলন হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক খন্দকার গোলাম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘মিলনের মা কোহিনুর বেগমের দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে। তদন্তে যারাই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের সবার নামই অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ 
 
তবে মিলনের চাচা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যরা সবাই চাকরি করছেন। ডিবি পুলিশও অভিযোগপত্র নিয়ে টালবাহানা করছে। পুলিশকে বাঁচানোর জন্যই এসবই হচ্ছে।’ ’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!