পর্নোগ্রাফি কি? গ্রীক শব্দ porne-(prostitute : পতিতা) এবং graphein-(to write লেখা)-এই শব্দ দু’টি থেকে pornography শব্দটি এসেছে এবং এর আসল অর্থ ছিল যৌনতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাহিত্য বা শিল্পকর্ম। আর এ পর্নোগ্রাফি হলো মানুষের সবচেয়ে বিতর্কিত অভিব্যক্তিগুলোর একটি।
বিশ্বায়নে পর্নোগ্রাফি এবং ইন্টারনেট : যৌনবৃত্তিতে নারী ও শিশুর ব্যবহার এবং পাচার বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু এর পরিমাণ বর্তমানে অনেক গুণ বেড়েছে এবং এটা এখন প্রাতিষ্ঠানিক আকার ধারণ করেছে। আর এই সব যৌন-বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হচ্ছে আইনগত বা আইন-বহির্ভুতভাবে একজনের কাছে বা একটা নির্দিষ্ট চক্রের কাছে পাচার করে, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বা পর্নোগ্রাফিতে বাধ্য করে নারী ও শিশুদের থেকে লাভবান হওয়া।
প্রযুক্তি এই যৌন-বিষয়ক প্রতিষ্ঠানকে নারী ও শিশু বাণিজ্যের একটা নতুন পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে। আর সেটা হলো ইন্টারনেট। যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ইন্টারনেটকে যদি কল্পনা করি, তবে এতে যৌন-বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ না হলেও চলে। কিন্তু ইন্টারনেট তো এখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এর সাথে অনেক ইন্টারনেট বিষয়ক প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে, আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচার ও প্রসার হতো না ঐ যৌন-বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ ছাড়া। এভাবে যৌন-বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এখন পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও দ্রুত অর্থের লেনদেন সম্পন্ন হওয়ায় এক ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পুরুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার যৌনাচার সম্পর্কে গোপনীয়তা পছন্দ করে, এটাই এসব অনলাইন যৌন-বিষযক প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতার মূল কারণ। যার সাহায্যে সে ডাউনলোড করতে পারছে পর্নোগ্রাফি, যা দিয়ে সে নিজের বিকৃত যৌনানুভূতিকে তৃপ্ত করতে পারছে। রাস্তাঘাটে খোঁজার ঝামেলা ছাড়াই অনলাইনেই পতিতাদের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পারছে।
কেন সমাজ থেকে পর্নোগ্রাফি দূর করার পদক্ষেপ নেব : স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে : পর্নোগ্রাফি মানুষকে যৌন বিকারগ্রস্ত করে তোলে, ফলে এইডস ছাড়াও অন্যান্য যৌনবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সমাজে ধর্ষণ, শিশু নিগ্রহ এবং আগ্রাসী যৌনতাকে প্ররোচিত করে।
নৈতিকতার ক্ষেত্রে : আমাদের সমাজ সব সময় চেষ্টা করে যাতে তার অধিবাসীদের ভালো দিকগুলো প্রকাশ পায় ও সেগুলো সমাজে কাজে আসে। কিন্তু পর্নোগ্রাফি আমাদের বিকৃত কামোত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে এবং আমাদের ভিতরের পশুসূলভ প্রবৃত্তিগুলোকে স্পর্ষকাতরের ন্যায় জাগিয়ে তোলে। এর ফলে সমাজের পুরুষ কর্তৃক নারীদের অধঃপতন লক্ষ্য করা যায়। এটা একটা সমাজে নিঃসন্দেহে অসহ্যকর কলঙ্কের চিহ্ন। নারীকে পণ্য হিসাবে বিক্রি, ব্যবহার অপব্যবহার সম্পূর্ণরূপে অনৈতিক। এ ব্যাপারে প্রশ্রয় দিয়ে কোন কালেই কোন সমাজ নিজেকে সভ্য সমাজ হিসাবে দাবি করতে পারেনি। সেই সমাজ ক্রমশ অধঃপতনে যাবে এবং নিজে নিজেই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।
মানসিক ক্ষেত্রে : পর্নোগ্রাফি হলো আমাদের কিশোর ও বয়ঃসন্ধিকালীন তরুণদের কাছে এক ধরনের যৌন শিক্ষক বিশেষ। যে বয়সে মানুষ পর্নোগ্রাফি বেশি দেখে সেটা হলো ১৪-২২ বছর। একটি জরিপে দেখা গেছে যে, এই বয়সী ছেলে ও মেয়েদের সামনে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শিত হলে এদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই প্রভাবটা ভয়ঙ্কর হবে, যদি পর্নোগ্রাফিটা বেশী উত্তেজনাকর হয়, বা এই প্রদর্শনীর দ্বারা সে যদি চরম কামোত্তেজক পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়। কিশোর ও বয়ঃসন্ধিকালীন তরুণদের সুষ্ঠু যৌনশিক্ষা না দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা ভাবতে থাকে যে তাদের এই চরম কামোত্তেজনা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারা এভাবে বড় হতে থাকে এক অবাস্তব ও রুগ্ন ধারণা নিয়ে। এটা তাদের মানসিক অবস্থার জন্য খুবই ক্ষতিকর। এর ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে অস্থিতিশীলতা, আর বেড়ে চলছে ডিভোর্সের সংখ্যা। এ ধরনের রুগ্ন মানসিকতা নিয়ে ছোটদের সাথে বড়দের সম্পর্ক তেমন একটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে না। ফলে দেখা গেছে ছোটরা বড়দের এড়িয়ে চলতে শিখছে।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে : পর্নোগ্রাফির ব্যবহারের ফলে পুলিশের তৎপরতা বাড়াতে হয়, পতিতালয় ও সিনেমা হলগুলোতে। যেসব এলাকায় আইন-বহির্ভুতভাবে এই পর্নো ব্যবসা শুরু হয়েছে, সেসব এলাকায় অন্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং দেখা গেছে যে, সেগুলো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে : অনৈতিক যৌনাচারকে বাড়িয়ে দেয় পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফি যে ধরনের বিকৃত আচরণ ও মানসিকতার জন্ম দেয়, তা বিশ্বের সব ধর্মেই নিষিদ্ধ রয়েছে।
যেভাবে আমরা পর্নোগ্রাফির কু-প্রভাব থেকে আমাদের প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি : শিশু-কিশোরেরা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তখন তারা যে কোন মুহূর্তেই যে কোনভাবে প্ররোচিত হয়ে পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়তে পারে এবং এতে আসক্ত হয়ে যাওয়াটাও অবাক হওয়ার মতো কিছুই নয়। এই আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকরা বুদ্ধিভিত্তিক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেমন : ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত হবে শিশু-কিশোরদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
* আপনার সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারকালে আপনি তাকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করুন।
* আপনার সন্তানের অল্প বয়স থেকেই তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।
* আপনি যদি আপনার সন্তানকে সন্দেহ করেন যে, সে কোন অরুচিপূর্ণ ওয়েবসাইট ঢুকে নগ্ন ছবি দেখছে, তখন তার সাথে রাগারাগি করবেন না বরং তার সাথে এ বিষয়ে সমঝোথার ভঙ্গিতে কথা বলুন।
* আপনার সাথে তাঁর যোগাযোগের সব ধরনের দরজা খোলা রাখুন।
* আপনার কম্পিউটারের History ফাইলগুলোও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
* আপনার বাসার কম্পিউটারটি কোন নির্জন স্থানে না রেখে, খোলামেলা জায়গায় রাখার চেষ্টা করুন।
* আপনার সন্তানের অনলাইন বন্ধুদের চিনে রাখার চেষ্টা করুন।
* স্কুল বা কলেজের কম্পিউটারগুলোর ইন্টারনেটটিতে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ফিল্টার ও ক্লক ব্যবহার করে কিনা, বা যথাযথ নিরাপত্তা গ্রহণ করে কিনা তারও খোঁজ খবর নিন।
* আপনার সন্তানকে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয় ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত করুন এবং বোঝানোর চেষ্টা করুন যে, এই ইন্টারনেট হলো শিক্ষার ও সৃষ্টিশীল চিন্তার খোরাকের অচিন্তনীয় উৎস। এছাড়া ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির মতো যে একটা খারাপ দিক আছে সেটা সম্পর্কেও জানাতে সহায়তা করুন, যাতে করে সে এক সময় নিজেই এগুলোকে এড়িয়ে যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে।
খুব ভালো হত যদি ইন্টারনেটকে পুরোপুরি পর্নোমুক্ত করা সম্ভব হত। এটা অনেকের মত। আবার অনেকে মনে করেন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিছু পর্নোসাইট ‘বিশেষ প্রয়োজন’ যেখানে শিশুদের প্রবেশ থাকবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এই যুক্তিতে যারা ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির পক্ষে অবস্থান করেন, তাদের যুক্তি নৈতিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে পর্নোগ্রাফির কি আসলেই কোন প্রয়োজন আছে? ইন্টানেট হোক বা অন্য কোন মাধ্যম থেকে পর্নোগ্রাফির কি আসলেই কোন উপকারিতা রয়েছে? প্রাপ্তবয়স্করা কি পর্নোগ্রাফি থেকে উপকৃত হন? তাছাড়া ইন্টারনেটের মত একটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি পূর্ণবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত আর শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ করলেই কি তাতে শিশুদের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব? সত্য বলতে কি, তা হচ্ছে না। সত্য বলতে কি শিশু হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক হোক সবার জন্য পর্নোগ্রাফি নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম একটি খারাপ মাধ্যম।
পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত কোন ব্যক্তিকে সুস্থমানসিকতা সম্পন্ন বলা চলে না। আমরা যখন মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস পড়েছি, তখন জেনেছি আদিম মানুষ যখন ধীরে ধীরে সভ্য হচ্ছিল তখন তারা নিজেদের শরীরকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে শিখেছিল। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, নগ্নতাকে আমরা আদিমতা আর কাপড় ব্যবহার করাকে আমরা সভ্যতার নির্দশন হিসাবে জানি। যে ব্যক্তি এই সভ্য যুগেও কম্পিউটারের মত অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে নগ্নতার মত আদিমতা খোঁজেন তার মানসিকতাকে সভ্য যুগের উপযোগী না বলে আদিম যুগীয় বললে ভুল বলা হবে কি? তাছাড়া প্রাপ্ত বয়স্কদের এই ‘বিশেষ প্রয়োজন, এর ফাঁকে একদল মতলববাজ ইচ্ছাকৃতভাবে পর্নোকে পৌঁছে দিচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে যারা ভালমন্দ না বুঝেই আসক্ত হয়ে পড়ছে নোংরামিতে, যা সমাজের জন্য বয়ে আনছে অশনিসংকেত, ফলে তৈরি হচ্ছে এমন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা নৈতিক দিক থেকে হচ্ছে বিকৃত ও দুর্বল।
তাই আমরা বলতে পারি যে, ইন্টারনেটকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ শৃঙ্খলিত করে আমাদের যেভাবে যতটুকু দরকার ঠিক সেভাবে ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট থাকতে পারলে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। এ ব্যাপারে দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও সরকারের এক সাথে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেই সাথে এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এভাবেই আমরা খুব শীঘ্রই নতুন প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও নিরাপদ ইন্টারনেট দিতে পারবো।