DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের একদফায় অনড় বেগম খালেদা জিয়া

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  ক্ষমতাসীন মিডনাইট হাসিনা সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নে কোনোরকম আপস না করতে দলের নেতাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের একদফা দাবিতে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করতে বলেছেন তিনি।

সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই নেতা দেখা করতে গেলে খালেদা জিয়া তাদের মাধ্যমে এই বার্তা দিয়েছেন। আন্দোলন জোরদারে ব্যর্থ হলে দলীয় নেতাদের দায়িত্বে থাকা নিয়েও বিএনপি চেয়ারপারসন প্রশ্ন তুলেছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতা আলাদাভাবে খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজায় যান। তারা দলীয় চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি তাকে চলমান আন্দোলন ও সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় অবহিত করেন। এ সময় খালেদা জিয়া নানা বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেন এবং দল ও আন্দোলন পরিচালনায় নানা নির্দেশনা দেন।

বিএনপি ঘোষিত একদফার আন্দোলন সম্পর্কে খালেদা জিয়ার সাফ কথা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একদফা আন্দোলনে কোনো ছাড় নয়। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, তা আরও জোরদার করতে হবে।

তিনি মনে করেন, ঠিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে ফলাফল আসবে, আন্দোলনেই দাবি আদায় করা সম্ভব। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে এক দফার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

নির্দেশনা দেওয়ার সময় খালেদা জিয়া বিএনপির ওই শীর্ষ দুই নেতাকে বলেন, ‘যদি আন্দোলন জোরদার করতে না পারেন, তাহলে দায়িত্বে থাকার দরকার কি? আপনারা না পারলে অন্য কাউকে দায়িত্বে আনতে হবে।’

দলীয় নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া আরও বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো গণভিত্তি নেই। তারা দেশের জনগণ থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বহির্বিশ্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। তারা পরিবর্তন চায়। অতএব দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে এই সরকারকে বিদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন আরও জোরালো করতে হবে। আন্দোলনেই এই সরকারকে বিদায় করতে হবে।’

এর আগে গত ২৯ জুন ঈদুল আজহার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে তার বাসভবন ফিরোজায় যান। সেখানে রাজনীতি নিয়ে তেমন কথাবার্তা না হলেও কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে স্থায়ী কমিটির এক নেতা চলমান আন্দোলনের প্রসঙ্গ তোলেন। তখন বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন সঠিক পথে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া।

স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চালিয়ে যান, এবার ফলাফল আসবে। ঠিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে।’

ওই সময় দলের একজন খালেদা জিয়াকে আবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এর জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জনসম্পৃক্ত আন্দোলনে এই সরকারকে বিদায় করতে পারলে সেটাই হবে বড় অর্জন। কে কী হবে, পরেরটা পরে। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যান।’

তারও আগে গত ৮ মে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে ফিরোজায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। এ সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষকে তা বয়কটের আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।

আন্দোলন প্রসঙ্গে মান্নাকে তিনি বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। ষড়যন্ত্র করে নেতাদের বিপথগামী করার চেষ্টা করবে সরকার। এ ক্ষেত্রে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে আন্দোলন জোরদার করতে হবে। দাবি আদায়ে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।’

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলেও মাহমুদুর রহমান মান্নার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। মান্নার বরাত দিয়ে নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে তখন খালেদা জিয়ার ওই বার্তা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল।

৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, চোখের সমস্যা, লিভারের রোগ ও হৃদরোগে ভুগছেন। গত বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা। এর আগে তিনি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ‘সাময়িক মুক্তি’ দেয় সরকার। এরপর থেকে তার দণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।

তবে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্তির পর থেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় খালেদা জিয়া। এ কারণে দল পরিচালনায় সাধারণত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন না। দলের মহাসচিব প্রতি মাসে ফিরোজায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও অন্য নেতাদের সেই সুযোগ সীমিত। তবে কারোর সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে চাইলে তাকে ফিরোজায় ডেকে পাঠান। মূলত দুই ঈদে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। আর মাঝেমধ্যে নেতারা দেখা করতে গেলে তাদের মাধ্যমে রাজনীতির খবর নেন এবং বিশেষ প্রয়োজনে নির্দেশনাও দেন। সংগত কারণেই খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। লন্ডন থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পরামর্শে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন তিনি।

দীর্ঘদিন পর গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে জনস্বার্থ ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামে বিএনপি। প্রায় চার মাস ঢাকাসহ দেশব্যাপী এককভাবে কর্মসূচি করার পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় দলটি, যা ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেশজুড়ে একযোগে শুরু হয়। এরপর টানা সাত মাস যুগপৎ আন্দোলন চলে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা ঘোষণা করে। দাবি আদায়ে দুদিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী ১৮ ও ১৯ জুলাই রাজধানীসহ দেশজুড়ে পদযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিএনপির এক দফার আন্দোলন। আর প্রথম দিনের কর্মসূচিতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয়। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে কৃষক দলের এক নেতা নিহত হন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দাবি, কর্মসূচি পালনকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দল যৌথভাবে বিএনপির নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে এক হাজারের অধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ প্রায় দুই হাজার আহত হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। যদিও পদযাত্রার পর মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। সহিংস পথে না হেঁটে টানা কর্মসূচির মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছতে চান নীতিনির্ধারকরা।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন চলছে। সরকার ও সরকারি দল যতই অত্যাচার-নির্যাতন করুক, যতই রক্ত ঝরাক—আমরা কেউ রাজপথ ছাড়ব না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

দলটির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন আর বিএনপির একার নয়। এটি এখন সারা দেশের মানুষের আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!