DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

শেষ পর্যন্ত মিডনাইট এমপি দিদারের অবৈধ শিপইয়ার্ড বন্ধ করল শিল্প মন্ত্রনালয়

আলাউদ্দিন আরিফঃ  চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকায় স্থানীয় অবৈধ সংসদ সদস্য (এমপি) দিদারুল আলমের একটি শিপইয়ার্ড বন্ধ (সাময়িক) বন্ধ করে দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। জাহাজ থেকে পড়ে শ্রমিক নিহতের পর চট্টগ্রাম-৪ আসনের এই এমপির মালিকানাধীন মেসার্স তাশিন স্টিল লিমিটেড নামে কারখানাটি গতকাল বৃহস্পতিবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া এমপি দিদারুল আলম ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে শিপইয়ার্ডকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা দিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় মেসার্স তাশিন স্টিল মিল সাময়িক বন্ধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব সোহেলা নাসরিন স্বাক্ষরিত এমপি দিদারুলের কারখানাটি বন্ধের আদেশ সংবলিত চিঠি গত বুধবার তার দপ্তরে পৌঁছে। পরে ওই চিঠিটি গতকাল কারখানা কর্র্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তিনি আরও জানান, এমপি দিদারুলের কারখানায় দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানকে প্রধান করে এবং সেফটি এজেন্সি মিতি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান এনাম চৌধুরীকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নিহতের পরিবারকে কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়।

এদিকে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ড এলাকায় এমপি দিদার ও তার ‘বাহিনী’র নানা অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকার বাসিন্দা মো. আতাউর রহমান সরকার। ওই অভিযোগে বলা হয়, ‘দিদারুল আলমসহ প্রভাবশালী একটি চক্রের কারণে অধিকাংশ শিপইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা শিপইয়ার্ড দখল করে নেওয়া, শিপইয়ার্ডের মালিকদের দাদন দিয়ে মোটা অঙ্কের সুদ আদায় করা এবং তাদের কাছে কম দামে স্ক্র্যাপ বিক্রি করতে বাধ্য করছে। এমপি ও তার সহযোগীদের কারণে বহু ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।’

অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘দাদন ব্যবসায় দিদারুল আলমের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাহাড়তলী সরইপাড়া ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা হাজি বাবুল এবং ভাটিয়ারি ইউনিয়ন বিএনপি নেতা হাজি সাহাব মিয়া। তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নানামুখী প্রলোভন দেখিয়ে দাদন দেওয়ার মাধ্যমে প্রতি ১ কোটি টাকায় মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা করে সুদ আদায় করেন।’

ভুক্তভোগীদের আরও অভিযোগ, দিদারুল আলমের বাবা আবু তাহের ওরফে তাহের কোম্পানি বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) সভাপতি। বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে হলে প্রায় ২০টি দপ্তরের নথির প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপজেলা প্রশাসনের অনাপত্তিপত্র, শিকস্তিভূমি লিজ নেওয়া, পরিবেশের ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স, বিনিয়োগ বোর্ডের ছাড়পত্র ও বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) সদস্য হওয়া ইত্যাদি। কোনো ব্যবসায়ী এমপির বা তার সহযোগীদের কথামতো কাজ না করলে প্রতিটি দপ্তরে ফোন করে সনদপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন এমপি নিজেই। তিনি উপজেলা প্রশাসনে ফোন করে ছাড়পত্র দিতে নিষেধ করে দেন। কোনো ক্ষেত্রে ওইসব জায়গায় ব্যর্থ হলেও তার বাবা আবু তাহেরকে দিয়ে বিএসবিআরের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন এমপি দিদারুল। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা চাঁদা পরিশোধ করা সত্ত্বেও সদস্যপদ নবায়ন করা হয় না। ফলে পুরো শিপইয়ার্ড ও জাহাজভাঙা শিল্প সাংসদ দিদারুল আলম ও তার পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

দুদকে জমা হওয়া অভিযোগের তথ্যমতে, দিদারুল আলমের কাছ থেকে দাদন নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মেসার্স তানিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম হাবীব, মেসার্স শীতল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী দিদারুল ইসলাম, মেসার্স মদিনা আয়রনের মালিক গিয়াস উদ্দিন কুসুম, মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজের মালিক ইসা বাদশা, মেসার্স কদম রসুল শিপইয়ার্ডের মালিক জানে আলম ও আজাদ, মেসার্স মাবিয়া শিপইয়ার্ডের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের মালিক জয়নাল আবেদীন সেলিম ও আলাউদ্দিন আলো, মিশম্যাপ শিপইয়ার্ডের মিজানুর রহমান শাহীন ও মুজিবুর রহমান মিলন, এফএনএফ শিপ রিসাইক্লিংয়ের মো. আলাউদ্দিন এবং প্রিমিয়াম ট্রেড করপোরেশনের জয়নাল আবেদীনসহ আরও অনেকে।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে আরও বলা হয়, সাংসদ দিদারুল আলম ও তার ভাই শাহীন আলম টিপু মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের মালিকানাধীন শিপইয়ার্ডটি দখল করে নিয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চৌধুরীঘাটা এলাকার শীতলপুরে বঙ্গোপসাগরের তীরে সাড়ে আট একর জমিতে এখন মেসার্স টিআর শিপব্রেকার্স। মাসে আড়াই লাখ টাকায় তিন মাসের জন্য ভাড়া নিয়ে ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের শীতলপুরের কারখানাটি দখল করে নেয় এমপি দিদারুল আলমের পরিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিআর শিপব্রেকার্স। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক। সেটি এখন দেখাশোনা করেন দিদারুল আলমের ভাই শাহীন আলম টিপু। ভাড়ার চুক্তি করে টিআর শিপব্রেকার্স নিজেদের অনুকূলে পরিবেশ ছাড়পত্রও নিয়েছে। এছাড়া টিআর শিপব্রেকার্স ইজারার নথি জাল করে।

এছাড়া দিদারুল আলম ও তার পরিবার চট্টগ্রামের ইসা বাদশার মালিকানাধীন সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া এলাকায় ঝুমা এন্টারপ্রাইজ শিপইয়ার্ডটিও দখল করে নিয়েছে। তাদের কাছ থেকে শিপইয়ার্ড উদ্ধারের চেষ্টা করলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। ওই অবস্থায় ইসা বাদশা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে আত্মগোপন করেন। দিদারুল আলম বর্তমানে সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ সোনাইছড়ি এলাকার শীতল এন্টারপ্রাইজ, কদম রসুলের মাবিয়া শিপব্রেকার্স ইউনিট-২, দক্ষিণ শীলতপুরের তানিয়া এন্টারপ্রাইজ ও ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপব্রেকার্সসহ বেশ কয়েকটি শিপইয়ার্ড দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন নিবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি দিদারুল আলম গতকাল বৃহস্পতিবার টেলিফোনে  বলেন, ‘জাহাজ ভাঙার যেকোনো কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করা হয়। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আমার কারখানার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। তারা তদন্ত শেষে খুলে দেবে।’

দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের কারণে কোনো শিপইয়ার্ড বন্ধ হয়েছে বিষয়টি সঠিক নয়। কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে থাকে তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন সেটা তদন্ত করবে। তারা বিষয়টি সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখবে।’

গত ৪ মার্চ দিদারুল আলমের মালিকানাধীন মেসার্স তাশিন স্টিল লিমিটেড নামে জাহাজভাঙার কারখানায় কাজ করার সময় রিপন মিয়া (২৭) নামে এক শ্রমিক নিহত হন।

সূত্রঃ দৈনিক দেশ রুপান্তর।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!