এস এম মাঈন উদ্দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)
এক অপরাধ সম্রাজ্ঞীকে আটক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিস্ফোরক ঘটনা ঘটে, যা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া এবং তার স্বামী মফিজুর রহমানকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-২ এর একটি দল ।
এরপর একে একে বেরিয়ে আসে তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন, অবৈধ সম্পদ, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, এবং অসামাজিক কার্যকলাপের ভয়াবহ চিত্র।
স্থানীয় এলাকায় 'কিউ অ্যান্ড সি' নামে একটি ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করে আসছিলেন এ দম্পতি। এ বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা দু'জন।
এদিকে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল রুমে পাপিয়ার আস্তানায় র্যাব অভিযান চালায়। অভিযান চালানো হয় ফার্মগেট এলাকার ২৮ নম্বর ইন্দিরা রোডের বিলাসবহুল ভবন 'রওশন'স ডমিনো রিলিভো'তে এই দম্পতির দুটি ফ্ল্যাটে। এতে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, পাঁচ বোতল দামি বিদেশি মদ ও ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এ ছাড়া পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক, কিছু বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ভিসা ও এটিএম কার্ড ১০টি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঐদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নয়াদিল্লিতে যাওয়ার সময় বহির্গমন গেট থেকে মফিজুর ও সাব্বিরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিন থেকে পাপিয়া ও তায়্যিবাকে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে আরো উদ্ধার করা হয় সাতটি পাসপোর্ট, বাংলাদেশি দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল টাকা, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ মার্কিন ডলার ও সাতটি মোবাইল ফোন।
র্যাব জানায়, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া পিউ নামেই বেশি পরিচিত। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে এর আড়ালে তিনি মূলত অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করতেন। কোনো কাজ বাগিয়ে নিতে পাঁচতারকা হোটেলে সুন্দরী তরুণীদের পাঠিয়ে মনোরঞ্জন করতেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, হোটেল ওয়েস্টিনের ২১তলার প্রেসিডেন্ট কক্ষটি গত নভেম্বর মাসে ভাড়া নেন পাপিয়া। তিনি গত তিন মাসে ওই কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। ১৯তলায় একটি বার রয়েছে, যেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যায়, গত তিন মাসে তিনি প্রায় তিন কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছেন হোটেল কর্তৃপক্ষকে।
শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, গাড়ির ব্যবসার আড়ালে তিনি (পাপিয়া পিউ) অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সমাজসেবার নামে তিনি নরসিংদীর অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করে আসছিলেন। অধিকাংশ সময় তিনি নরসিংদী ও রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করেন। সেখানে তার ও তার স্বামীর ব্যবসায়িক অংশীদারদের অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য নারী সবরবরাহ করাই ছিল তার মূল কাজ।
গ্রেফতারের পর এই চারজনের বিরুদ্ধে জাল টাকা উদ্ধারের অভিযোগে বিমান বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
নরসিংদীতে তোলপাড় : স্বামীসহ পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের খবর জানার পরপর নরসিংদীতে তোলপাড় শুরু হয়। যেদিন গ্রেফতার হয় সেইদিন এ খবরই ছিল 'টক অব দ্য টাউন'। পাপিয়ার সঙ্গে অনেকের ছবিই গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে পাপিয়ার স্বামী নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান। অনেক আগে থেকেই চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত তিনি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলেন পাপিয়ার স্বামী। এলাকায় পাপিয়া ও তার স্বামী নরসিংদী সদর আসনের এমপি লে. কর্নেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম হিরু (বীরপ্রতীক) বলয়ের লোক হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও পাপিয়া চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। হঠাৎ পাপিয়া এত বড় পদ পাওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া বলেন, পাপিয়াকে রাজনীতির মাঠে আমদানি করেছেন এমপি নজরুল ইসলাম হিরু। এর দায় দলের অন্য কেউ নেবে না।
এ ব্যাপারে জানার জন্য নরসিংদী সদরের এমপি নজরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নরসিংদীর একাধিক রাজনৈতিক নেতা জানান, পাপিয়া যে ঢাকা অভিজাত হোটেল ভাড়া নিয়ে অসামাজিক ব্যবসা চালাতেন এটা অনেকেরই জানা ছিল। তবে প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার ওঠবস থাকায় এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছুই বলতেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকই বলেছেন- পাপিয়ার অপরাধের অবৈধ উপার্জনের ভাগ পেতেন যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল । এদিকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া আটকের পর তাকে আজীবনের জন্য যুব মহিলা লীগ সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।
শামীমা নূর পাপিয়ার অপরাধের পরিধি শুধু অর্থ ও নারী পাচারেই সীমাবদ্ধ নয়—তিনি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে একটি সুসংগঠিত অপরাধ চক্র পরিচালনা করতেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।



