দুর্নীতিবিরোধী অভিযান থেমে গেল কোথায়? ক্যাসিনো থেকে আবরার হত্যাকাণ্ডে আলোচনার মোড়

এস এম মাঈন উদ্দিন (২৫ ডিসেম্বর ২০১৯)

২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো অভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। দলীয় প্রভাবকে উপেক্ষা করে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়।

অভিযান শুরু: সেপ্টেম্বর–অক্টোবর ২০১৯

  • ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯: ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়।

  • ১৯ সেপ্টেম্বর: যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হন।

  • ২৩ সেপ্টেম্বর: সম্রাট, সেলিম প্রধান, শামীমসহ একাধিক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়।

  • ২ অক্টোবর: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন—“জঙ্গিবাদ, মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে, দল-মত-পরিবার বলে কিছু নেই।”

অভিযান থেমে যায় কোথায়?

অভিযান যখন গতি পাচ্ছিল, ঠিক তখনই ৬ অক্টোবর ২০১৯ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগ নেতারা পিটিয়ে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আলোচনার কেন্দ্র থেকে সরে যায়।

সরকারের অবস্থান

  • ২১ সেপ্টেম্বর: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “অপরাধী যে দলেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

  • ৫ অক্টোবর: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন। এটি অব্যাহত থাকবে।”

বাস্তবতা ও জনমতের প্রশ্ন

অভিযান শুরু হলেও তা কার্যত ক্যাসিনো কেন্দ্রিক ক্লাবগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর আর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সচেতন নাগরিকদের প্রশ্ন—এই অভিযান কি থেমে গেছে? নাকি এটি রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত?

আওয়ামী দুঃশাসনের প্রেক্ষাপট (২০০৯–২০১৯)

  • ২০০৯: পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরকারের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ।

  • ২০১১: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় শাসনের সূচনা।

  • ২০১৩: শাপলা চত্বরে হেফাজতের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী অভিযান।

  • ২০১৪ ও ২০১৮: জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল, আগের রাতে সিল মারা—সবই একদলীয় শাসনের অভিযোগে ঘেরা।

  • ২০১৯: ক্যাসিনো অভিযান, আবরার হত্যাকাণ্ড, রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা প্রকাশ—সব মিলিয়ে বছরজুড়ে আলোড়ন।

 

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন

  • টানা তৃতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১৯ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। তবে এই নির্বাচন নিয়ে ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, আগের রাতে ব্যালট ভর্তি করার অভিযোগ ওঠে।

  • বিরোধী দলের দমন: বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো, গৃহবন্দী রাখা, এবং বিদেশে চিকিৎসায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ ছিল। দলটির দাবি, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৬০ লাখের বেশি মামলা হয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন

  • গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: ২০০৯–২০২৩ সময়কালে অন্তত ২,৬৯৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার এবং ৬৭৭ জন গুম হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য। র‍্যাবের বিরুদ্ধে ‘ক্রসফায়ার’ হত্যার অভিযোগও রয়েছে।

অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও সংকট

  • খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি: ২০১৯ সালের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.১৬ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১২%। ব্যাংক খাতে নানা কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

  • ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান: যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, ঘুষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির অভিযোগে অভিযান চালানো হয়।

আলোচিত হত্যাকাণ্ড

  • নুসরাত জাহান রাফি: ফেনীর এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়।

  • আবরার ফাহাদ: বুয়েট ছাত্র আবরারকে ছাত্রলীগের নেতারা পিটিয়ে হত্যা করে, যা সরকারের ভারতপন্থী নীতির সমালোচনার জেরে ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।

এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে অনেকেই রাজনৈতিক নাটক হিসেবে দেখছেন। যদিও সরকার দাবি করছে, তদন্ত চলছে এবং অভিযানের সমাপ্তি হয়নি, বাস্তবতা বলছে—অভিযান এখন আর দৃশ্যমান নয়।

২০১৯ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক দ্বৈত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অভিযান শুরু করে, অন্যদিকে সেই অভিযানই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো ঘিরে কিছু নাটকীয় গ্রেপ্তারে। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের অপসারণ, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার—সবই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিযান ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়, এবং জনমনে প্রশ্ন জাগে—এই অভিযান কি শুধুই রাজনৈতিক শুদ্ধির মোড়কে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস?

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড, নুসরাত জাহান রাফির নির্মম মৃত্যু, রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা, সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দলের দমন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে ২০১৯ সাল ছিল এক অস্থির, দ্বন্দ্বপূর্ণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ শাসনের বছর। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের শুরু যতটা জোরালো ছিল, তার পরিণতি ততটাই অস্পষ্ট। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা এলেও বাস্তবে তা আর দৃশ্যমান নয়।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালকে শুধু একটি রাজনৈতিক বছর নয়, বরং একটি গণতন্ত্রের পরীক্ষার বছর হিসেবে বিবেচনা করা যায়—যেখানে জনগণের প্রত্যাশা, সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবতার মধ্যে ছিল এক গভীর ফাঁক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই যদি সত্যিই অব্যাহত থাকে, তবে তা হতে হবে দলীয় সীমার বাইরে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে। নইলে ২০১৯ সালের মতো অভিযানগুলো কেবলই রাজনৈতিক নাটক হয়ে থাকবে, আর জনগণের আস্থা আরও একধাপ পিছিয়ে যাবে।

 

Share this post

scroll to top