DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিরোধী দল বিরাট ব্যবধানে জিতবে: ভারতের কূটনৈতিক অঙ্গন

দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ  পাকিস্তানের পরাজিত সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। তার পাশে ধীর শিকারির মতো বসে ওই ঐতিহাসিক দলিলে নিয়াজির স্বাক্ষর করা প্রত্যক্ষ করছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, যিনি ছিলেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক।

পাকিস্তানের পরাধীনতার যাঁতাকল থেকে স্বাধীনতা পেতে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল ভারত। ঠিক ৪৭ বছর বাদে বাংলাদেশ ৩০শে ডিসেম্বর রবিবার নির্বাচনে যাচ্ছে। কিন্তু এবার ভারত ঠিক নিশ্চিত নয় বাংলাদেশকে কার গ্রাস থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করা উচিৎ।

শেখ হাসিনার সরকার থেকে? নাকি ঝামেলাপরায়ণ খালেদার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থেকে? ক্রমেই দুর্নীতিপরায়ণ, স্বৈরতান্ত্রিক ও অহঙ্কারি হয়ে উঠা আওয়ামী লীগের হাত থেকে? নাকি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র হাত থেকে যেটি সচরাচর দুর্নীতিপরায়ণ ও ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন? চীনের সঙ্গে ক্রমেই দহরম মহরম শুরু করা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে? নাকি বিএনপির হাত থেকে যেটি আষ্টেপৃষ্টে ইসলামিস্ট জামায়াত?

 

হাসিনা সবসময়ই ছিলেন ভারতের সেরা বাজি। তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরাধী ও ইসলামিস্টদের পিছু নিয়েছেন। অনস্বীকার্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধন করেছেন। তিনি ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। প্রতিবেশী দেশসমূহে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করার যে নীতি পাকিস্তানের, সেই ব্যাপারে স্পষ্ট ছিলেন হাসিনা।

কিন্তু দেশে ভাবা হয়, তিনি আগাগোড়া দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কাঁচা ও চাটুকার স্বভাবের লোকেরা তার চারপাশে। ভিন্নমত দমনে তিনি অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় বলপ্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছেন। গত এক বছরে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা জনঅসন্তোষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে কোটা ও সড়ক নিরাপত্তার মতো আন্দোলনে, দৃশ্যত তুচ্ছ কারণে।

প্রতিবাদরত শিশু-কিশোরদেরকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান একজন আলোকচিত্রীকে একটি সাক্ষাৎকারের জেরে আটক করে আতঙ্কগ্রস্ত সরকার। এসবের কারণে ইতিমধ্যে পড়তির দিকে থাকা সরকারের জনপ্রিয়তায় আরও ধস নামে।

যতই সরকারের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হয়েছে, ততই বেপরোয়া সব পদক্ষেপ নিয়েছে হাসিনা সরকার। যে হাসিনা স্থিরচিত্তে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, জামায়াত-চালিত ইসলামি ব্যাংক চুর্ণবিচুর্ন করেছেন, হলি আর্টিজান বেকারি সন্ত্রাসী হামলার খুনীদের খুঁজে খুঁজে দমন করেছেন, সেই হাসিনাই আবার হেফাজতে ইসলামের মোল্লাদের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন এজেন্সি বলছে, এই নির্বাচনে তার দল থেকে প্রায় ৩০ জন জামায়াত-ঘেঁষা ব্যক্তি মনোনয়ন পেয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, চীন এই নির্বাচনে ৩ হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে। মূলত আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পেছনেই ব্যয় হয়েছে এই অর্থ। কিন্তু চীনা অর্থের বদান্যতার মেয়াদ চীনা পণ্যের মতোই সীমিত। চীনা ড্রাগন খুব অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই অনুপাতহীন সুদ দাবি করে বসে, যেমনটা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, হাসিনার জনপ্রিয়তা যতই পড়তির দিকে ছিল, ততই ভারত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ভারত এই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।

অপরদিকে বিএনপি সবসময়ই পাকিস্তানের দিকে ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু এবার দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। তাদের অনেককে নয়াদিল্লি প্রকাশ্যেই আতিথেয়তা দিয়েছে।

বিএনপির প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে টের পেয়ে, ভারতের অনেক এজেন্সি বেশ কয়েকজন বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে, যারা কিনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভারতপন্থী। তবে এটি মূলত ক্ষেত্রবিশেষে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় আর তার ফলে সরকার পরিবর্তন হয়, তার কথা মাথায় রেখেই এই কৌশল ভারতের।

কিন্তু ভারত এমন একটি বিএনপি সরকার ঘৃণা করে, যেটি কিনা পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে জামায়াতের প্রভাব বৃদ্ধি করবে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও অনুপ্রবেশকারীরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে অবাধে চলাচল করতে পারবে।

বাংলাদেশের কক্সবাজারে প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের। এটির প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস থেকে শুরু করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভ্যাশন আর্মির প্রধান করাচিতে জন্ম নেওয়া আতাউল্লাহ পর্যন্ত মিয়ানমারের সন্ত্রাসী নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মাঝেমাঝে বিয়ে ও পারিবারিক সূত্রেও সম্পর্ক রয়েছে দুই পক্ষের।

ভারত চায় না, জামায়াত-ঘেষা একটি সরকারের কাছ থেকে আনুকূল্য পাক এসব গোষ্ঠী। কিংবা বাংলাদেশের ঘরোয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান ঘটুক।

এছাড়াও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা বিভাগের অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমানকে অপছন্দ করেন। তারা বলছেন, তারেক রহমান ‘ভালো মানুষ নয়’ বলে তাদের মনে হয়। তারা আরও বলেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর হাসিনা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে, তারেকের ফোনকলেই খালেদা সিঁড়ি থেকে ফিরে যান কক্ষে। এ থেকে যে তিক্ততা তৈরি হয় তা আর শুকোয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকর্মী ড. কামাল হোসেন, যিনি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান, তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। তিনি একজন আইনজীবী। একসময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, তিনি অনেক বেশি আশাবাদী, যার ফলে পরিস্থিতি যতখানি চায়, তার চেয়েও বেশি মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলেন তিনি। কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুর মেয়ের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ আরও ভয়াবহ কিছুর।

কিন্তু কামাল হোসেনের বয়স ৮২ বছর। তিনি মাঠের রাজনীতিকও নন। ওদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে দেখা হয় আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে। তার বয়সও ৮৮। ভারত মনে করে, তার যখন-তখন ইউ-টার্ন নেওয়ার ঝোঁক আছে। এছাড়া তার উত্তরাধিকারী কে হবে, তা স্পষ্ট নয়। এছাড়া ভারত তাকে বেশি জোরালোভাবে সমর্থন দিলে দেখা যাবে, জাতীয় পার্টি হয়তো কিছু বেশি আসন পেয়ে যাবে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অপরদিকে আওয়ামী লীগেরও ভোট যাবে কমে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত ‘মাইনাস টু’ ফরমুলা অর্থাৎ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। যেকোনো বিকল্প সরকার বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হবে না। ফলে দেশ আরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারে, ফলে ফের নাক গলানোর কথা ভাবতে পারে সেনাবাহিনী।

ভারতের সেরা বাজি কে?
শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ৭ মাস আগে, ভারতের গোয়েন্দা প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও ব্যক্তিগতভাবে তাকে একটি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু হাসিমুখে তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘তারা আমার নিজের সন্তানের মতো। তারা আমার ক্ষতি করবে না।’

তার মেয়ে হাসিনাও তার কর্মকান্ড ও ক্রমবর্ধমান অজনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের কয়েকদফা উপদেশ অগ্রাহ্য করেছেন। ভারত এখনও তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু কোনো শক্তির উত্থান ঘটলে ভারত বুদ্ধিমানের মতো তাদের জন্যেও দরজা খোলা রাখছে। ভারতের কূটনৈতিক অঙ্গনের সাধারণ মনোভাব হলো এরকম যে, ‘হাসিনাকে জিততে হবে। অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও আমরা জানি কিভাবে সব সামাল দিতে হবে।’

তারা স্বীকার করছেন যে, যেভাবে আবেগ বইছে বাংলাদেশে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিরোধী দল হয়তো বিরাট ব্যবধানে জিতবে। তারা আরও মনে করেন যে, নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত হবে এমনটার সম্ভাবনা নেই। ভুতেরা নিশ্চিতভাবেই ভোট দেবে কিংবা অন্যদের ভোট দিতে বাধা দেবে। ভারত কি পর্যবেক্ষক পাঠাবে। হেসে একজন উত্তর দিলেন, না। আমাদের এমনিতেই বাংলাদেশে অনেক ‘পর্যবেক্ষক’ রয়েছে।

(অভিজিৎ মজুমদার ভারতীয় সাংবাদিক। তার নিবন্ধটি মাই ন্যাশন থেকে নেওয়া হয়েছে।)

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!