DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিশ্বখ্যাত জার্মান মিডিয়া ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণেও বাংলাদেশ এখন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সম্প্রতি জার্মানির প্রখ্যাত থিংকট্যাংক বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে তাদের ‘ট্রান্সফর্মেশন ইনডেক্স ২০১৮’। ১২৯টি উন্নয়নশীল দেশের এই সূচকে ৫৮টি দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বার্টলসম্যান বলছে, এই বছর স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় ঢুকেছে নতুন করে পাঁচটি দেশ।

এগুলো হলো বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডা। বাংলাদেশ কি তাহলে স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হচ্ছে ?

এবার জার্মানির সরকার-অর্থায়নে পরিচালিত সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনটির ভাষান্তরিত করে পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

এতে বলা হয়, নিজেদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বার্টলসম্যান লিখেছে, ‘নির্বাচনের মানের অবনতি ঘটায় একসময়কার পঞ্চম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটি ফের স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘নাগরিকদের জন্য এই বিষয়গুলো উদ্বেগজনক, কেননা স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে দুর্নীতি, সামাজিকভাবে ছিটকে পড়া এবং সুষ্ঠু অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাধা-বিপত্তি অব্যাহতভাবে বেশি বিরাজমান।’ ২০০৬ সাল থেকে ১২৯টি উন্নয়নশীল ও রূপান্তরশীল দেশের গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি ও সুশাসনের মানের ওপর সূচক প্রনয়ণ করে আসছে ব্যার্টলসম্যান।

বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ এই গবেষণামূলক সূচককে ভিত্তিহীন হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবশ্য দাবি করেছে, এই সূচক বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সত্যিকার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল মতিন খসরু স্থানীয় গণমাধ্যমকে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি শতভাগ গণতান্ত্রিক দেশ। এই গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘সম্ভবত, জার্মানি-ভিত্তিক থিংক ট্যাংকটি ভুল সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সপৃক্ততা নেই। অথবা বাংলাদেশ বিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিরোধী লোকজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।’

বার্লটসম্যান ফাউন্ডেশনের এই সূচকের প্রকল্প ব্যবস্থাপক রবার্ট সোয়ার্জ বলেছেন, গবেষণার ফলাফলের ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উচিত হবে প্রতিবেদনটি পড়ে দেখা। তিনি বলেন, ‘রিপোর্টের বাংলাদেশ অংশে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে যে, সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই কিছু ক্ষেত্রে এই ক্রমবর্ধমান অবনতিতে ভূমিকা রেখেছে।’

সোয়ার্জ আরও বলেন, প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক উৎপাদন, ব্যাষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাজার-ভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিমালাকানাধীন ব্যবসার মতো অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রগতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থার পৃথকীকরণ ও বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার মতো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবনতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

গণতন্ত্র ‘অবনতিশীল’

বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাটলসম্যানের গবেষণায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবনতিশীল যেই অবস্থার কথা উঠে এসেছে তার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের অভিমতেরও মিল রয়েছে। এই অবনতিশীল অবস্থাকে ত্বরান্বিত করছে রাজনৈতিক বহুত্বের অভাব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত রেষারেষি।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, বাংলাদেশ খুব দ্রুতগতিতে স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হওয়ার পথে ধাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘শাসক দল বিরামহীনভাবে বারবার রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে। এই দমনপীড়ন প্রায়ই বেশ সহিংস ছিল। এই দেশটি একদলীয় রাষ্ট্র হওয়ার বিপজ্জনক পথে দাঁড়িয়ে আছে। দেশটি পথ পরিবর্তন করতে সক্ষম হলে আলাদা কথা।’

প্রধান বিরোধী নেত্রী কারাগারে

বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফেব্রুয়ারিতে এক দুর্নীতির মামলায় কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এক দশক আগে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ওই মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানী ঢাকার একটি বিশেষ আদালত তাকে একটি তহবিলের অর্থ তছরুফের অভিযোগে ৫ বছরের সাজা দেয়।

অভিযোগ আছে, ৭২ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের কারাদন্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও তাকে এ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টার অংশ। কুগেলম্যান বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের মধ্যে শত্রুতার ইতিহাস এবং বিরোধী পক্ষকে নাজেহাল রাখতে সরকারের বিরামহীন চেষ্টার কথা বিবেচনায় নিয়ে, আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করবো যে, এসব আইনি পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের গবেষণা পরিচালক সিগফ্রিড ও. ওলফ এ ব্যাপারে একমত যে, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির গণতান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিত বেশ ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। তবে তিনি মনে করেন না যে, সব দোষ কেবল বর্তমান সরকারের।

তিনি বলেন, ‘এটি খুবই সংকীর্ণ হবে যদি কেউ শুধু বর্তমান সরকারকেই দেশটির গণতন্ত্রের বেহাল দশার জন্য দায়ী করেন। এমন যুক্তিতে যে তথ্য অনুপস্থিত তা হলো, বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। অনেক দুর্ভাগ্যজনক গতিপথের সঙ্গে সংশ্লেষ পাওয়া যাবে পূর্বেকার সরকারগুলোর।’

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে

বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরের ওই সহিংস প্রতিবাদে শতাধিক মানুষ নিহত হন। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। দলটির দাবি ছিল, নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হোক। ১৯৯১ সালের পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এই নির্বাচন হতো। কিন্তু বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০১০ সালে ওই পদ্ধতি বাতিল করা হয়।

বিএনপি এর পর থেকে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। দলটির বেশিরভাগ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই সহিংসতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ঝুলছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী নিহত, অপহৃত অথবা কারান্তরীন।

সিগফ্রিড ওলফ বলেন, দুই প্রধান দলের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত দ্বন্দ্ব ও তাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্রোধও দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।’

অংশগ্রহণ মুলক নির্বাচন কি হবে?

খালেদা জিয়া কারান্তরীন থাকলে বিএনপি আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বর্জন করার হুমকি দিয়েছে। শাসক দল আওয়ামী লীগ বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে আনতে কোন ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় নি।

ঢাকার একজন রাজনীতি বিজ্ঞানী শান্তনু মজুমদার মনে করেন, আসছে সাধারণ নির্বাচন অংশগ্রহণমুলক হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া বৈ বিএনপির সামনে কোনো পথ খোলা নেই। আবার ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন করার পর্যায়ে নেই আওয়ামী লীগও।

বিশ্লেষক কুগেলম্যানও প্রায় কাছাকাছি মত দিয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘বিএনপি খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নির্ভর করছে দলটি এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করবে কিনা তার ওপর। এই নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা আছে ভালোই। আমার মনে হচ্ছে যে, খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাবেন। মুক্তি দেওয়ার আগে তাকে আটকে রেখে কড়া বার্তা দিতে চায় শাসক দল।’

ব্যাটলসম্যানের সূচকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, সরকারের উচিত হবে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে আসছে মাসগুলোতে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!