DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

আপাতত আওয়ামী লীগে লতিফ অধ্যায় অবসানঃ মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ এবং দল থেকে বহিষ্কার

1412344171দল-মন্ত্রিত্ব সবই হারালেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। পবিত্র হজ, মহানবী(সঃ) ও তাবলিগ জামাত নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার ১৫ দিনের মাথায় রবিবার দুপুরে মন্ত্রিত্ব হারান তিনি। সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তাকে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়।

 

বৈঠক সূত্র জানায়, কার্যনির্বাহী কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গণভবনে বৈঠক চলছিল। বৈঠকের প্রারম্ভিক বক্তব্যে শেখ হাসিনা হজ নিয়ে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যকে ‘গর্হিত কাজ’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, এজন্য তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এটা বলল আমি জানি না, কিসের জন্য বলল জানি না; তবে যেটা বলেছে তা গর্হিত কাজ বলেই আমি মনে করি।’ বক্তব্যের পর দলীয় নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা। 



প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন যে, সাম্প্রতিককালে আমাদের একজন মন্ত্রী, প্রাক্তন মন্ত্রীই বলতে হয় এবং আমাদের প্রেসিডিয়াম মেম্বার লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে আমাদের নবী করিম (সা.) সম্পর্কে, হজ সম্পর্কে এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন, যেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। তার মানে এই না যে, ধর্মহীনতা।

ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে সকল ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো। তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে একজন মন্ত্রীর যেভাবে নিয়োগ অবসান হয়, লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে সেভাবেই হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন হজ চলছে এবং বাংলাদেশ এত সুন্দর করে হজে যাওয়ার ব্যবস্থাপনা করেছে; যেখানে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হজে গেছেন, ঠিক সে সময় আমাদের দলের কেউ এই ধরনের কটূক্তি করবে, মন্তব্য করবে এটা তো কখনোই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। বিষয়টা জানার সাথে সাথেই আমি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছি। আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম ফাইল তৈরি করতে।

কেবিনেট ডিভিশনে ফাইল তৈরি ছিল। কেবিনেট সেক্রেটারি হজ থেকে আসার পর তার সঙ্গে আমি বসেছি। কেবিনেট সেক্রেটারিসহ মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গেছি। তারপর উনি সেটা সই করে দিলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি, কারণ প্রত্যেকটা মুসলমানের মনের মধ্যে একটা আঘাত লাগবে— এটা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য না। ধর্মের বিষয়ে নিজের দলের অবস্থান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই সব থেকে বেশি ধর্ম পালন করে, সব থেকে বেশি নামাজ পড়ে। সব থেকে বেশি হজ, হাজীর সংখ্যা সব থেকে আমাদেরই বেশি। ধর্মীয় নিয়মনীতি মানা, গরিবের প্রতি দরদ, মায়া-মমতা, তাদের জন্য কাজ করা সব থেকে বেশি আমরাই করি। 



এদিকে রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটান। এর পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর মধ্য দিয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে চলমান সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল।



রবিবার বিকালে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুযায়ী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদের নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (১) দফার (গ) উপদফা অনুসারে তার নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ প্রদান করেন। এর ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।’ দায়িত্ব থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপনে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য কারণ উল্লেখ করার কোনো আবশ্যকতাও নেই। সংবিধানেও এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।’ দায়িত্ব থেকে অবসানের অর্থ ‘অপসারণ’ না ‘অব্যাহতি’— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুটো একই বিষয়। এর অর্থও এক। আমরা সাংবিধানিক ভাষা ব্যবহার করেছি।’



বিভিন্ন গণমাধ্যমে লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের খবর সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’ শীঘ্রই মন্ত্রিসভার রদবদল করা হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়েও এখন আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। সচিব জানান, ‘ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে অন্য কাউকে অর্পণ না করা পর্যন্ত রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর বিধি ৩ (৪) অনুযায়ী এ মন্ত্রণালয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবে।’

এদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (১) দফার (গ) উপদফা অনুযায়ী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান হয়েছে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে।’



রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাত্: রবিবার দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সাক্ষােক ‘সৌজন্য সাক্ষাত্’ বলা হলেও আদতে লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণের বিষয়ে অনুমোদন নিতেই এ সাক্ষাত্ ছিল বলে সূত্র জানিয়েছে।



রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দুপুর ১টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাতের সূচি ছিল পূর্বনির্ধারিত। তবে প্রধানমন্ত্রী দুপুর ২টায় বঙ্গভবনে পৌঁছান। এ সময় তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা ছাড়াও  মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সঙ্গে ছিলেন।



সাক্ষাত্ শেষে বের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ সাক্ষাত্ মূলত সৌজন্য সাক্ষাত্। পবিত্র হজ পালন করতে যাওয়ায় ঈদুল আজহার সময়ে রাষ্ট্রপতি দেশে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। রাষ্ট্রপতিও প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।’



লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণের বিষয়ে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভা থেকে তার অপসারণের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত ছাড়া কার্যকর হবে না। লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তার সিদ্ধান্তের কথা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি সেটাতে অনুমোদনও দিয়েছেন।’ অব্যাহতির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকবে।’ 



এদিকে শনিবারই লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের অবসানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। শনিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে (লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ) একটি ফাইল আসবে। আমরা একটি সামারি তৈরি করে তা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠাব। রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’ প্রজ্ঞাপন কবে জারি করা হবে— তা জানতে চাইলে তিনি তখন বলেন, ‘এর চেয়ে অনেক বড় বড় কাজ আমরা কম সময়ে করেছি। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’



এর আগে গত ৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না। ওই সময় প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নির্দেশ দিলে রিজাইন (পদত্যাগ) করতে হবে। নইলে বিদায় করে দিতে হবে। কিন্তু বিদায় দিতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল পাঠাতে হবে। রাষ্ট্রপতি হজে গেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হজে গেছেন। আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ফাইল তৈরি করে রাখতে বলেছি, অফিস খুললে ফাইল চলে আসবে।’ দল থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘বাদ দিতে হলে তা নিয়ে দলে আলোচনা করতে হবে। অভিযোগ তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটি যদি মনে করে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া ভালো— তা হলে অব্যাহতি দিয়ে দেবে।’



টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের জ্যেষ্ঠজন ৭১ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতিতে স্পষ্টভাষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তির্যক বক্তব্য দিয়ে এর আগেও আলোচনায় এসেছেন তিনি। নিজের ভাই আবদুল কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাত্ জামায়াত ঘনিষ্ঠতাকে’ যেমন তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন, তেমনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পিটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।



টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে পাঁচবার সংসদে যাওয়া লতিফ সিদ্দিকী গত মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চলতি বছরের শুরুতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তবে এই লতিফ সিদ্দিকীই ৮০-এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন, আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। ষাটের দশকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিনগুলোতে একাধিকবার কারাগারে যেতে হয় বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য লতিফ সিদ্দিকীকে। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে করটিয়া সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬-এর ছয় দফা ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী সাংসদ হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি।



রাষ্ট্রীয় সফর শেষ হওয়ার পরও এখনও লতিফ সিদ্দিকী বিদেশেই অবস্থান করছেন। এর মধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় গত শনিবার পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে। 



প্রসঙ্গত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের পালকি পার্টি সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্রের টাঙ্গাইল জেলা সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেন। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে নিজে পদত্যাগ না করলে অপসারণ করা হবে বলে ঘোষণা দেন।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!