লন্ডন থেকে সিরাজুর রহমানঃ প্রথমেই আমি বলবো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিবিসি থেকে আমরা তার বক্তৃতার রেকর্ড সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু আমি ফরাসি রেডিওর কাছ থেকে তার রেকর্ড সংগ্রহ করেছি। অবশ্য ওরা বিএনপির বিরুদ্ধে ওটা আর স্বীকার করবে না।
আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, তাজউদ্দিন সাহেব ১৯৭১ সালে আশ্রিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তিতে কিছু কিছু কথা ছিল যে দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না। বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে ভারত এবং আরো বলা হয়েছিল বিডিআরকে ভেঙ্গে দিতে হবে এবং বিডিআরের পরিবর্তে বিএসএফ, ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড গঠন করা হবে।
যাই হোক, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ দফা চুক্তি মেনে নেননি। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করেন। এরপর তাকে ৭ দফা চুক্তিতে রাজি করানোর জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু মুজিব তাতে রাজি হয়নি। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি করেছিলেন, বিডিআর বাহিনী তিনি ভেঙে দেননি।
এরপর দেখা গেল মোশতাকের বিরুদ্ধে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হলো যাতে খালেদ মোশাররফ নেতৃত্ব দেন। সেদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল। বিবিসিতে সংবাদ আমি প্রচার করেছিলাম এবং সেটাকে ব্যাপকভাবে মনে করা হতো ভারতের অনুকূলে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের অনুপ্রেরণায় সেটা সংগঠিত হয়েছিল।
এখন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি করে হতে পারে? বাঙালি সংস্কৃতি হতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ? বিমানবন্দরে আপনাকে যখন জাতীয়তা জিজ্ঞেস করে, তখন আপনি বলেন বাংলাদেশি অথবা ব্রিটিশ।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমি প্রথমবার তার সাক্ষাৎকার নিতে যাই ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন কর্নেল অলি ছিলেন তার Personal secretary. তিনি টেপ রেকর্ডারটা কর্নেল ওলির হাতে দিয়ে বলেন, Oli, you have to look after Mr Rahman's tape recorder. Guard it with your life. It is as important to him as a Rifel to you and me. তারপর উনি বললেন, আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই। ভাববিনিময় করতে চাই। আমরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলাম, তার সার কথা হলো খুব সহজ। তিনি গোড়াতেই বাংলাদেশের সমস্যাগুলো নিয়ে বলেছিলেন।
জিয়া তখন বললেন, সেনাবাহিনীতে এসব নিয়ে বড় একটা সমস্যা আছে। সেনাবাহিনীতে 'Chain of command' পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তারপর তিনি বলেছিলেন, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ কে করেছে, কে করেনি তা নিয়ে সংশয়। কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, কেউ ছিল না। এখন যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, তারা তো তখন ভুল করেছিল। এখন তো তারা এখানে আছে। এদের যদি আমি জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত না করি, তবে এরা যাবে কোথায়? উনি আমাকে বললেন, আপনি তো বিলেতে থাকেন, আপনি কি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে বলে দেখবেন এদের নেবে কিনা? আর যখন কেউ নেবে না তখন আমি কি করবো? আমি কি তখন এদের সকলকে বঙ্গপোসাগরে ফেলে দিয়ে আসবো?
তারপর উনি আমাকে বলেছিলেন, আমি জানি বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। আমরা জানি, শেখ মুজিবুর রহমান পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে ভুল করেছে। আমি খুব শীঘ্রই পত্রিকাগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাই। বাকশাল করে সবগুলো রাজনৈতিক দলকে বেআইনি করে দেয়া হয়েছিল। আমি সবগুলো রাজনৈতিক দলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র যথাসত্বর চালু করার জন্য আমি বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছি।
জিয়াউর রহমানের অর্জন আপনারা সবাই জানেন। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ বইটিতে জিয়াউর রহমান ছাড়াও তারেক রহমানের কথা আছে। তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী দর্শন পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সম্পর্কে আমি ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ভালোভাবে জানা শুরু করি। যখন তিনি তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাজ করেছিলেন। তিনি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে আবার জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। তারপরে উনার হাওয়া ভবন নিয়ে উনি কাজ করেছেন।
রাজনীতি নিয়ে কাজ করলে শুধু হবে না, রাজনীতি নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক এবং তৃণমূলকে নিয়ে যে রাজনীতি করা হয়, তারেক রহমান সে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আমরা তার সুফল দেখেছি। তার সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে তখন আমি বেশি করে অবগত হয়েছি।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও তারেক রহমান’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলাম লেখক সিরাজুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণ।

