DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ইরাকের তিক্ত অভিজ্ঞতা: সেনাবাহিনীর পক্ষপাত যেভাবে ডুবায় একটি দেশকে

slide_354156_3864431_free-300x200 দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারে তার সর্বশেষ উদাহরণ ইরাক। ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া’ নামের একটি সশস্ত্র গ্রুপ প্রায় বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছে সমস্ত ইরাক। ইরাকের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ব্যবহার করেছে এবং তার কুফল নিয়ে লিখেছেন ইরাকের খ্যাতিমান সাংবাদিক আবু নুরী। আবু নুরীর লেখাটি বাংলাভাষায় রূপান্তর করে প্রকাশ করা হলো:

ইসলামী সশস্ত্র একটি গ্রুপ ইরাকী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করল এবং এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সমস্ত ইরাকের সুন্নী প্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়ে নিল। একটি সশস্ত্র গ্রুপ এত সহজে কাজটি পারল কিভাবে? এর কারণ এই না যে, ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া’র (আইএসআইএস) যোদ্ধারা ইরাকের সেনাবাহিনীর চাইতে অস্ত্র-সস্ত্রে বেশি সুসজ্জিত ছিল, বরং এর কারণ হচ্ছে, ঐতিহাসিকভাবেই ইরাকের রাষ্ট্রজন ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন সদ্ভাব বা সুসম্পর্ক ছিল না।

সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সুন্নী। তিন দশক ধরে সাদ্দাম হোসেন সেনাবাহিনীকে তার বিপক্ষ লোকজনের নির্যাতন ও খুন করার কাজে ব্যবহার করেছেন। আর সাদ্দাম হোসেনের পতনের পরের দশ বছর ধরে, ইরাকের শিয়া শাসকরাও সুন্নীদের প্রতি একই আচরণ করেছেন। এখন সুন্নীদের প্রধান অভিযোগ, সেনাবাহিনী মধ্যরাতে তাদের বাড়িতে হানা দেয় আর বাথ পার্টির (সাদ্দামের পার্টি) সদস্য হওয়ার অভিযোগে বাড়ির পুরুষদের আটক করে। অথচ বাথ পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটি বিলুপ্ত হয়েছে এগার বছর আগে।

দু’পক্ষের মধ্যে শত্রুতায় সেনাবাহিনীকে এতটাই ব্যবহার করা হয়েছে যে, ইরাকের জনগণ রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটির প্রতি আর কোন বিশ্বাস-আস্থা কিছুই রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, ইরাকের অধিকাংশ লোকজন বিদ্রোহীদের চাইতেও পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীকে বেশি ভয় পায়।

ইরাকের পুরাতন ও নতুন সেনাবাহিনীর কাজ আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তারা রাষ্ট্রজনদের সাথে কী কী অন্যায়, অপরাধ করে তাও দেখেছি। ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী আমার শহর, কুর্দিস্তানের হালাবজা আক্রমণ করে এবং একদিনেই ৫ হাজার মানুষকে মেরে ফেলে। পরে তারা আরো ১ লাখ কুর্দি গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করার পর মরুভূমিতেই কবর দেয়।

তিন বছর পর, সাদ্দামের সেনাবাহিনী দক্ষিণে উঠতি শিয়াদের নির্যাতন করে ও ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ২০০৩ সালে সাদ্দামকে আমেরিকানরা আটক করার পর, আমি ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে গিয়েছিলাম। এবং দেখলাম, সেখানকার পরিবারগুলো গণকবর খুঁড়ছে। হিলা, আবু গারিব, কিরকুকের অনেক কবরের প্রান্তে দাঁড়ালাম এবং নীরবে দেখলাম, বালির ভেতর থেকে নারী, শিশু আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হাড়গোড় বের করা হচ্ছে।

গত ১০ বছরে ইরাকে একটাই মাত্র পরিবর্তন এসেছে, আর তা হল শাসক। আগে সুন্নীরা ছিল, এখন শিয়ারাই শাসক হয়েছে। তবে তারাও সুন্নীদের মত সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। আমি ইরাকের ছোট্ট সুন্নী শহর হাওয়িজায় গিয়েছিলাম। শহরটা এমনিতেই বিচ্ছিন্ন, ধূলাবালিপূর্ণ, নোংরা। সেখানে ইরাকের শিয়া সরকার অধিকাংশ মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত করে শহরবাসীর জীবন আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে।

মসুলে সাধারণ মানুষ ও সেনাসদস্যদের সাথে আমি অনেক দিন কাটিয়েছি। তিকরিত, ফালুজা ও রামাদিতে আমি আদিবাসী রাঁধুনী ও সেখানকার লোকজনের সাথে দুপুরের খাবার খেতেও অভ্যস্ত ছিলাম। পরবর্তিতে তারা সবাই বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল। একইরকমভাবে, আমি শিয়া অধ্যুষিত প্রদেশ যেমন কুট থেকে শুরু করে কারবালা, নাজাফ থেকে বসরা নগরীও ঘুরে বেড়িয়েছি।

দেশটির রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে সর্বত্র একটি ভাল কথাই আমি শুনেছি। সেটি হল- কর্তৃপক্ষের প্রতি চরম অবিশ্বাস। শিয়ারা, যারা তাদের প্রিয়জনদের হাড়গোড় বালি খুঁড়ে বের করেছিল, তারা সাদ্দামের শাসন কিংবা তার পরবর্তিতে আসতে পারে এমন সুন্নী শাসকদের চরম ঘৃণা করত। আর সুন্নীরা দেশটির নতুন শিয়া রাজনীতিবিদদের পেলে ফাঁসিতে ঝোলাত- এমন অবস্থা। শিয়াদেরকে তারা ডাকে বিশ্বাসঘাতক, আমেরিকান দালাল ও ইরানি পুতুল নামে।

শিয়া ও সুন্নীদের দ্বন্দ্ব অবশ্যই ঐতিহাসিক। তবে গত বেশ কয়েক দশক ধরে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব ইরাকি সেনাবাহিনীতে সংঘাতকে গভীর থেকে গভীরতর করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার অভিনব অভিজ্ঞতা কুর্দি, শিয়া ও সুন্নীদের রয়েছে। তারা জানে সেনাবাহিনী কিভাবে একটি সরকারের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে? এবং এক বা একাধিক দলের উপর নির্যাতন চালানর ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী কতটা কার্যকর।

এই কারণেই ইরাকের শিয়া ও কুর্দিরা সাদ্দামের বাহিনীর বিরুদ্ধে সুযোগ পাওয়ামাত্রই বিদ্রোহ করেছিল এবং সুন্নীরাও এখন যে কারণে সুযোগ পাওয়া মাত্রই নির্দয়ভাবে ইরাকি সেনাবাহিনীর সদস্যদের খুন করছে। বেশ কয়েক বছর আগে, বাগদাদে যখন আমি যুদ্ধের সংবাদ কাভার করতে যাই, প্রায় প্রত্যেকদিনই এক একটা আর্মি রিক্রুটমেন্ট সেন্টারে গাড়ি বোমা-বিস্ফোরণ ঘটত। বোমায় এই সব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীরগুলো ছিল তরুণ রিক্রুটদের। বিদ্রোহের একদম শুরু থেকেই, সেনাবাহিনীই ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্য।

আমি দেখতাম, সুন্নী কারাবন্দীদের সাথে শিয়া সেনারা কী অমানবিক আচরণ করত আর কী নিষ্ঠুরভাবেই না সুন্নী সেনারা শিয়াদের খুন করত!

আগের মত এই শত্রুতা এখনও বিদ্যমান এবং এই কারণেই, ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া’ (আইএসআইএস) যোদ্ধারা সুন্নী এলাকাগুলোতে খুব ভাল সময় কাটায়। মসুল কিংবা ফালুজার সাধারণ জনগণ এই দলের ইসলামী ব্যাখ্যা পছন্দ করে না, কিন্তু তারা একে শিয়া চালিত ও সেনা শাসিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখে ও প্রশ্রয় দেয়।

কুর্দিদের অংশে, কুর্দিদের জমিতে ইরাকী যোদ্ধারা পা ফেলার চিন্তাও করে না। তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে বলেও তারা মনে করে। ২০০৩ সালের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের পুনঃনির্মাণে তারা সাহায্য করেছে অথচ তাদেরকেই ধীরে ধীরে সরকারি পদগুলো থেকে সরান হয়েছে। সর্বশেষে বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশও বাদ দিয়েছে বাগদাদ।

প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, তেলের সমুদ্রের উপর বসে আছে ইরাক। কিন্তু এরা অনেকগুলো গণকবরের উপরও বসে আছে। বহু বছর ধরে একে অন্যের দ্বারা অপব্যবহৃত হয়ে আসছে যে মানুষগুলো, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সমাধান হল তাদের আলাদা আলাদা পথে যাওয়া। একে অন্যকে সহ্য করতে পারে না এমন ভিন্ন মতাদর্শের সহিংস লোকজনকে একই ছাদের নিচে রাখার কোন মানে হয় না। শিয়া, সুন্নী ও কুর্দিদের একই ছাদের নিচে রাখার পয়েন্ট থেকে অনেক বাইরে সরে এসেছে ইরাক।

বিভক্তিগত কারণে ইরানের বিপুল জনসংখ্যার স্থানান্তর নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন হতে পারেন। কিন্তু যে সহিংস সেক্টরিয়ান যুদ্ধ গত কয়েক দশক ধরে হয়েছিল, তা ইতোমধ্যে এই কাজটি, স্বেচ্ছায় কিংবা জোরপূর্বক, অনেকাংশে সম্পন্ন করে ফেলেছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!