DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সোমালিয়া ফেরত লিমনের দুর্বিষহ বর্ণনাঃ ‘গভীর রাতে ঘাড় পর্যন্ত গর্তে ঢুকিয়ে মাটিচাপার ভয় দেখিয়ে ফোন করাত’

Nabikগভীর রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে বাগানে নিয়ে যেত। সেখানে মাটি খুঁড়ে একজন একজন করে ঘাড় বরাবর মাটি চাপা দিয়ে মুক্তিপণের জন্য স্বজনদের কাছে ফোন করাত।

২০১১ সালের ২৬ জুন এক ইন্ডিয়ান ক্রুকে হত্যা করে আমাদের দিয়ে লাশ ফ্রিজে ঢোকানো হয়। এরপর আমাদের জাহাজ মালিকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করায় দস্যুরা।’— এভাবেই সোমালিয়া জলদস্যুদের হাত থেকে ফিরে আসা লিমন তার নির্মম ও দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার দশানী সরকারবাড়ির ওয়ালী উল্লাহর ছেলে লিমন সরকার। ত্রিশ বছর বয়সী লিমন জীবিকার সন্ধানে ইরানি মালিকানাধীন এবং মালয়েশিয়া থেকে পরিচালিত জাহাজ কোম্পানি ম্যাজেস্টিক অ্যান্ড রিস শিপিং লাইন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন।

কোম্পানির মূল কাজ হলো বহির্সমুদ্রে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কন্টেইনার পরিবহন। এই কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিত লিমন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে আটক হয়। তাদের কাছেই সাড়ে তিন বছর পার হয় বিভীষিকাময় জীবন।

’ চার বছর পর লিমন গত রবিবার দুপুরে মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছেন। ঢাকা থেকে বাড়িতে পৌঁছলে তৈরি হয় আনন্দঘন এক পরিবেশ। লিমনকে দেখতে বাড়িতে হাজির আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ এলাকাবাসী। সোমবার বিকালে লিমনের বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, সোমালিয়ার জলদুস্যদের লোমহর্ষক দুস্যতার কথা। লিমন বলেন, ‘কোনো দিন ভাবিনি দস্যুদের হাত থেকে বেঁচে আসতে পারব। এজন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

’ লিমন এসএসসি পাস করার পর বিএনএসে ট্রেনিং করে ২০১০ সালের ১ আগস্ট জাহাজে চাকরি নেন। শুরুতেই ইরানে যান। ইরানের বন্দর আবাবায় ট্রেনিং শেষে তাকে সৌদি আরবের বন্দরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে কেনিয়া, এরপর সুদান পাঠায় ওই জাহাজে করে। জাহাজে ছিল শতাধিক কন্টেইনার। জাহাজটি কেনিয়া থেকে সুদান যাওয়ার পথে জলদস্যুদের হাতে আটক হয়।

লিমন জানান, ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর সকাল ৭টার সময় জলদস্যুরা একে-৪৭ ও রকেট লঞ্চারসহ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জাহাজে ওঠে। এ সময় জানালার গ্লাস ভেঙে সাত দস্যু ভিতরে ঢুকে ক্রুসহ সব স্টাফকে আটক করে। ওই সময় আরেকটি মাছের জাহাজ থেকে ১১ দস্যু ঢোকে। পরের দিন ২৭ নভেম্বর আরও ৩০-৩২ দস্যু এসে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর দস্যুরা ২০ মিলিয়ন ইউএস ডলার দাবি করে জাহাজ মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে।

তিন মাস পর মালিকের খোঁজ পায় দস্যুরা। জাহাজ মালিক ৩ লাখ ডলার দিতে রাজি হলে দস্যুরা ক্ষেপে ওঠে। দাবিকৃত ডলার পরিশোধ না করলে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এভাবে কয়েক মাস কেটে গেলে দস্যুরা জাহাজের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য দালালচক্রের সহযোগিতা নেয়। দর কষাকষির একপর্যায়ে ওই দস্যুরা জাহাজের কন্টেইনার ভেঙে সব মালামাল নিয়ে যাওয়া শুরু করে। এই মালামাল জাহাজ থেকে নামাতে শ্রমিক হিসেবে তাদের কাজে লাগানো হয়।

লিমন জানান, ১৮ মার্চ ২০১২ সালে দস্যুদের সঙ্গে মালিক পক্ষের ২.৮ মিলিয়ন ডলারে মুক্তির ব্যবস্থা করার আগ মুহূর্তে জাহাজটি ডুবে যায়। তখন শ্রীলঙ্কান নাগরিক জাহাজের চার ক্রু মারা যান। এরপরই মালিকপক্ষ চুক্তি থেকে সরে আসে। পাকিস্তানি নাগরিকদের ১ মিলিয়ন ডলারে ছাড়িয়ে নেয়া হয়। আর লিমনসহ সাত বাংলাদেশির মুক্তির বিষয়ে জাতিসংঘের একটি টিম কাজ শুরু করে।

জাতিসংঘের টিমের সঙ্গে দস্যুদের বহুবার দর কষাকষির এক পর্যায়ে ৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মুক্তি পান লিমনরা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিমন বলেন, দীর্ঘ প্রায় চার বছর দস্যুরা আমাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করেছে। সারাদিন জাহাজ থেকে মালামাল নামানোর কাজে ব্যবহার করত।

আর গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে গহিন বনে নিয়ে মাটি খুঁড়ে গলা বরাবর ঢুকিয়ে মাটি চাপার ভয় দেখিয়ে বাড়িতে স্বজনদের কাছে ফোন করাতে বাধ্য করত যেন দাবিকৃত টাকা দ্রুত পাঠানো হয়। লিমন জানান, প্রতিদিন আধা লিটার পানি দেয়া হতো। আর ওই পানিটুকু দিয়ে বাথরুমসহ সব কাজ সারতে হতো। খাবারের মধ্যে ছিল শুধু রুটি, ডাল, সাদা ভাত। লিমনের বয়োবৃদ্ধ বাবা ওয়ালি উল্লাহও সকলকে কৃতজ্ঞতা জানান ছেলেকে ফেরত আনার জন্য।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!