DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সাতছড়িতে র‌্যাবের গোপন অভিযানে বিপুল সমরাস্ত্র উদ্ধারঃ ভারতের নতুন সরকার আসার পর হঠাৎ এই বিপুল অস্ত্র উদ্ধার সন্দেহজনক ও অবিশ্বাস্য

habiganj1গত তিনদিন ধরে অভিযান চালিয়ে হবিগঞ্জের সীমান্তবর্তী উপজেলা চুনারুঘাটের সাতছড়ির গহিন বনে সমরাস্ত্রের বিশাল মজুদের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। এখান থেকে ৫টি বাংকার থেকে তিনটি মর্টার শেল, দু’শ রকেট লঞ্চার, রকেট চার্জার, ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ ছোট-বড় অস্ত্র উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। তবে ভারতের নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এই বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার যথেষ্ট কৌতুহল এবং সন্দেহের জন্ম দিয়েছে ।

habiganj2এ জঙ্গল থেকে আরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এখানে অভিযান অব্যাহত থাকবে। র‌্যাব হেডকোয়ার্টার ও র‌্যাব-৯-এর আড়াই শতাধিক জওয়ান ছাড়াও র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড, বিস্ফোরক দল এ অভিযানে অংশ নিয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের তিন কিলোমিটার ভেতরে চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ির এ বনে র‌্যাব অভিযান চালাচ্ছে। বনে একশ’ ফুট উঁচু টিলার মাঝামাঝি স্থানে বাংকারে অভিযান চালাচ্ছেন আড়াই শতাধিক র‌্যাব সদস্য। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ও মুখপাত্র এটিএম হাবিবুর রহমানও সেখানে রয়েছেন।

habiganj3র‌্যাবের মিডিয়া উইং কমান্ডের প্রধান কর্নেল হাবিবুর রহমান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব হেডকোয়ার্টার ও র‌্যাব-৯-এর এর সদস্যরা রোববার রাত ১টার দিকে অভিযান শুর করে। র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক সানা শাহীনুর রহমানের নেতৃত্বে আড়াই শতাধিক র‌্যাব সদস্য উপজেলার সাতছড়ি habiganj4বনবিটের অভ্যন্তরে এবং টিপরা পল্লীতে এ অভিযানে নামেন। অভিযানে র‌্যাব সদস্যরা টিপরা পল্লীতে দুটি এবং পল্লীর অদূরে গভীর জঙ্গলে একটি টিলায় ৩টি বাংকারের সন্ধান পায়। ২০ থেকে ২৫ ফুট গভীর এসব বাংকারের মুখে আরসিসি ঢালাই করা। ৫টি বাংকারের মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র একটি বাংকারে বিপুল পরিমাণ রকেট লঞ্চার ও ৩টি মর্টার শেলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। ৪টি বাংকারে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

habiganj7ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি বনবিট। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরে অস্ত্র পাওয়া গেছে। এলাকাবাসীর দেয়া তথ্যানুযায়ী এ বনবিটের গভীর অরণ্যে একসময় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘ক্যাম্প’ ছিল। এসব ক্যাম্পে আস্তানা ছিল উলফা, এটিটিএফ এবং এনএলএফটির। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ২০০৫ সালের পর এদের আনাগোনা আর চোখে পড়েনি। তাছাড়া ২০০৩ সালে সাতছড়ি থেকে পাঠানো বিশাল অস্ত্র, গোলাবারুদের চালান আটক হয়েছিল বগুড়ার কাহালুতে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের পর সাতছড়ি এলাকা গোয়েন্দাসহ প্রশাসনের দৃষ্টিতে চলে আসে। পরবর্তীকালে সাতছড়িতে বেশ কয়েকবার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

 

 

habiganj8এক পর্যায়ে তারা সাতছড়ি ত্যাগ করে। তবে মাঝে মাঝে তাদের আনাগোনা ছিল এমন কথা বলছেন কেউ কেউ। সাতছড়ির গহিন অরণ্যে থাকা ত্রিপুরা পল্লীর লোকজন জানান, ২০০৭ সালের পর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আর দেখা যায়নি। র‌্যাব জানায়, তাদের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন কয়েক সপ্তাহ ধরে সাতছড়ি বনবিট ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এলাকায় সাদা পোশাকে ঘোরাফেরা করেন। এ সময় তারা পল্লীর ত্রিপুরা সদস্য, স্থানীয় বাসিন্দা এবং চা বাগানের চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন সাতছড়ি জঙ্গলে উলফা কিংবা এটিটিএফ সদস্যদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এমনকি বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে এ জঙ্গলে। বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিত হয়েই র‌্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে জানানো হয় র‌্যাব-৯-এর কমান্ডার সানা শাহীনুর রহমানকে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার বিকালে সাতছড়িতে র‌্যাবের একটি গোয়েন্দা দল আসে। রাত ১টার দিকে র‌্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে বিপুল পরিমাণ র‌্যাব সদস্য সাতছড়ি পল্লী ঘিরে ফেলে। র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক সানা শাহীনুর রহমান, হেডকোয়ার্টারের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মুফতি মাহমুদ খানের নেতৃত্বে প্রায় ২শ’ র‌্যাব সদস্য এ অভিযানে নামে। প্রথমে তারা পল্লীতে তল্লাশি চালায়। এ সময় পল্লীতে অবস্থানরত সব পুরুষ লোক ভয়ে পালিয়ে যায়। চিত্ত দেববর্মা নামে পল্লীর হেডম্যান ওই রাত থেকে পলাতক রয়েছে। র‌্যাব পল্লীর পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দুটি সেমিপাকা ঘরের নিচে দুটি বাংকারের সন্ধান পায়। কিন্তু এসব বাংকার খুঁড়ে কাউকে কিংবা কোনো গোলাবারুদ পায়নি। পরে তারা চলে যায় পল্লীর প্রায় ৫ গজ দূরে জঙ্গলের অভ্যন্তরে। সেখানে খুঁজে পায় আরও দুটি বাংকার। এসব বাংকারে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ দেখে তারা খবর পাঠায় র‌্যাবের ডিজিকে।

এদিকে বাংকারের সন্ধানে র‌্যাব সদস্যরা কাছাকাছি সব টিলায় অভিযান চালায়। কিন্তু সোমবার দিনভর তল্লাশি করে আর কোনো বাংকার খুঁজে পায়নি। মঙ্গলবার সকালে একই টিলায় খুঁজে পায় আরও একটি বাংকার। এ বাংকারেই রয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় অস্ত্র উদ্ধারের কাজ। প্রায় ৩ ঘণ্টার অভিযানের পর একটি বাংকার থেকে উত্তোলন করা হয় বিপুল পরিমাণ রকেট লঞ্চার, ৩টি মর্টাল শেল, মর্টালের ক্লিনার, ওয়েলসহ বিপুল পরিমাণ ছোট ছোট রকেট লঞ্চার। এক পর্যায়ে শুরু হয় অঝোরে বৃষ্টি। এ বৃষ্টির মধ্যেই ব্রিফিং দেয়া হয়। ব্রিফিংয়ে হাবিবুর রহমান বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমাদের অভিযান চলছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। আরও কয়েকদিন এ জঙ্গলে আমাদের সদস্যরা অভিযান চালাবে। কারা কি উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র এখানে রেখেছে তা তদন্ত করে দেখা হবে। এর সঙ্গে জড়িত কাউকে র‌্যাব আটক করতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জড়িতদের খুঁজে বের করার। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, দেশের ইতিহাসে এটিই ভারী অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম মজুদ উদ্ধারের ঘটনা।

এর আগে চট্টগ্রামে চোরাচালানের ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তবে এই অস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্ঠী বা কোনো জঙ্গি সংগঠনের কি-না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারা, কোন উদ্দেশ্যে এখানে এই ভারী অস্ত্র মজুদ করেছিল তা-ও র‌্যাবের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে খুব তাড়াতাড়িই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে র‌্যাব। এদিকে সাতছড়ির গভীর জঙ্গলে এবং র‌্যাবের এ অভিযান অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে চালানোর কারণে সোমবার বিষয়টি জানাজানি হয়নি। বিপুুলসংখ্যক র‌্যাব সদস্যের আনাগোনায় মঙ্গলবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হয়।

এ খবরে সকালে হেলিকপ্টারে করে সাতছড়ি ছুটে আসেন র‌্যাবের সহকারী ডাইরেক্টর জেনারেল কর্নেল জিয়াউল হাসান, মিডিয়া উইং কমান্ডের প্রধান কর্নেল হাবিবুর রহমান, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মুুফতি মাহমুদ খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ বিষয়টি জানাজানি হলে সেখানে ছুটে যান মিডিয়া কর্মীরা। দুপুরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করেন কর্নেল হাবিবুর রহমান। র‌্যাবের সাতছড়ি অভিযানের ব্যাপারে অত্যন্ত গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হয়। এমনকি খোদ স্থানীয় পুলিশও বিষয়টি জানত না। অভিযানের ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে আগাম অবগত করেনি র‌্যাব। পুলিশ পরে অভিযানের খবর জেনেছে।

এমন বক্তব্য চুনারুঘাট থানার ওসি অমূল্য কুমার চৌধুরীর। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখার সঙ্গে সাতছড়ির ত্রিপুরা পল্লীর লোকরা জড়িত থাকতে পারে বলে র‌্যাব সন্দেহ করছে। কারণ যে ৫টি ব্যাংকারের সন্ধান পাওয়া গেছে তার দুটো ত্রিপুরা পল্লীতে। বাকি ৩টি পল্লীর একটু দূরে। ২০ থেকে ২৫ ফুট গর্ত করে আরসিসি ঢালাই ও ইট দিয়ে যখন এসব ব্যাংকার তৈরি করা হয় তখন ত্রিপুরা পল্লীর লোকজন এ ঘটনা জানত বলে র‌্যাব ধারণা করছে। পল্লীতে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্যরা এসব ব্যাংকার তৈরি করে অবস্থান করলেও পল্লীর কেউ বিষয়টি পুলিশ প্রশাসন কিংবা গোয়েন্দাদের জানায়নি। তাদের জ্ঞাতসারেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এসব কাজ করেছে বলে র‌্যাব মনে করছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, সাতছড়ির বনাঞ্চলের একটি অংশে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা। সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা। সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি গোষ্ঠী অস্ত্রের মজুদ করছে- এমন খবর পেয়ে র‌্যাব সকালে অভিযান শুরু করে।

বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাশের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি সংগঠনের সদস্যদের ওই এলাকায় আনাগোনা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কেউ অস্ত্রগুলো মজুদ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে স্থানটিতে এই বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তা একসময় অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের (এটিটিএফ) আস্তানা ছিল বলে জানা যায়। ত্রিপুরার এই বিদ্রোহী দলটি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের তিন কিলোমিটার ভেতরে চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ির এই বনে অস্ত্র থাকার প্রাথমিক তথ্য পেয়ে কয়েক দিন ধরে অভিযানের প্রস্তুতি চলছিল বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অভিযান চলাকালীন সময় সাতছড়ি টিপরা বস্তি এলাকায় ছিল সুনসান নীরবতা।

 

অধিকাংশ বাড়িঘরে দরজা, জানালা বন্ধ রাখা হয়। তবে অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। পরে র‌্যাব সদস্যরা টিপরা বস্তির ৩০০ গজ দক্ষিণে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার পাহাড়ি নির্জন স্থানে অভিযান চালিয়ে চারটি মাটির নিচে পাকা বাঙ্কারের সন্ধান পান। এর পর র‌্যাবের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা এক্সক্লুসিভ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে এসব বাঙ্কারে বিস্ফোরকের সন্ধান পান। উদ্ধারকৃত ১৮৪টি রকেট লঞ্চার, ৩টি মর্টার শেল, বিপুল পরিমাণ রকেট লঞ্চার চার্জার ও অস্ত্র ক্লিনারে মরিচা পড়ে গেছে। এসব লঞ্চার ও শেল ৭-৮ বছর মাটির নিচে পড়ে থাকার কারণে মরিচা ধরেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

কারণ কাহালুতে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের চালান আটক হয়েছিল ১০ বছর আগে। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ২৭ জুন বগুড়ার কাহালু উপজেলায় আনারসের ট্রাকে ১৭৪ কেজি বিস্ফোরক এবং প্রায় ১ লাখ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র উদ্ধারের পর সাতছড়ি আলোচনায় আসে। তদন্তে উঠে আসে সাতছড়ি থেকেই এসব গোলাবারুদ ও অস্ত্র পাচার হয়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় পুলিশের হাতে আটক এ গোলাবারুদ ও অস্ত্র আটকের পর অবশিষ্ট এসব অস্ত্র থাকতে পারে। পরবর্তীতে এসব অস্ত্র সুযোগ না থাকায় তারা সরিয়ে নিতে পারেনি বলে মনে করা হচ্ছে। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!