DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ভারতের ভ্রান্ত বাংলাদেশ নীতি পরিত্যাগ খুবই প্রয়োজন

সিরাজুর রহমানঃ  সরকার যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল। ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে ভারত ‘হঠাত্ করেই বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণদানের প্রস্তাব দিয়ে বসল। অন্তত সে ধারণাই দিতে চায় সরকার। তারা বলছে, ভারতের কাছে তারা ঋণ চায়নি। প্রথম দৃষ্টিতে সৌভাগ্যই বলতে হবে। না চাইতেই এমন মোটা অঙ্কের ঋণ! চাইলে না জানি আরও কত মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসত ভারত! ভাগ্য ভালো। এখন আমি অর্থকষ্টে ভুগছি বলা সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু এককালে অর্থকষ্ট আমারও ছিল। তখন কেউ অযাচিত ঋণের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেনি। বরং ঋণ চাইব ভয় করে কেউ কেউ রাস্তার অন্যদিক দিয়ে হেঁটেছেন। 
ফাটা কপালের মতো ভারতের এই আকস্মিক ঋণদানের আগ্রহ সেজন্যই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক ভেবেচিন্তে কিছুটা হদিশ পাওয়া গেল বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী এবং ভারতের যুগ্ম সচিব অরবিন্দ মেহতার কিছু মন্তব্যে। দু’দেশের বৈঠকের সাফল্য সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তারা যেসব কথা বলেছেন তার থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে ভারতীয় মোটরযান চলাচলের মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের কন্টেইনার ট্রেন সার্ভিস চালু, নদীপথে ট্রানজিটের জন্যে স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের ভেতরের লিংক রোডগুলোর উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। 
আপনাদের মনে থাকার কথা, ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জী ঢাকা এসে ঘোষণা করেছিলেন, ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। বিস্তারিত বিবরণ পাওয়ার পরে জানা গেল, ভারতকে রেলসড়ক ও নদীপথে ট্রানজিট দান এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অধিকারদানের জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামোগুলোর উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হবে সে ঋণ। ভারত আরও শর্ত দিয়েছিল, অবকাঠামোগুলোর উন্নতির কাজ নির্বাহ করবেন ভারতীয় প্রকৌশলীরা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ইত্যাদি আসবে ভারত থেকে। অর্থাত্ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ হবে বাংলাদেশে, কিন্তু তা থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে না।
ঢাকায় উভয় দেশের যুগ্ম কমিটির বৈঠকে আরও যেসব অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, সেসব কাজও খুবই ব্যয়বহুল হবে। ভারত সরকার জানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ দুর্নীতি, ‘ফুটানি প্রকল্প’ এবং বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসা দ্রুত হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন শোচনীয় দৈন্য দশা। ভারতকে ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট ইত্যাদি সুবিধা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যয় নির্বাহের সামর্থ্য শেখ হাসিনার সরকারের নেই। খুব সম্ভবত সেজন্যই অগ্রবর্তী হয়ে এই ঋণদানের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত, কেননা হাসিনা যে কিছুদিন গদিতে আছেন তার মধ্যেই যা তারা পেতে চায় উশুল করে নিতে হবে, নইলে অনির্বাচিত হাসিনাকে গদিতে রেখে দিল্লির সরকার যেভাবে বাংলাদেশের মানুষের ক্রোধের মাত্রা আকাশচুম্বী করে তুলেছে, তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষ ‘যথাসর্বস্ব’ ভারতের হাতে তুলে দিতে রাজি হবে না।
ভারতের দয়া যেতেও কাটে আসতেও কাটে
ইংরেজি হিতোপদেশ হচ্ছে : ইবধিত্ব ড়ভ ঃযব এত্ববশ নবধত্রহম মরভঃং. (যে গ্রিক উপহার নিয়ে আসে তার থেকে সাবধান)। এ প্রবাদের উত্পত্তি প্রাগৈতিহাসিক ট্রয়ের (বর্তমানে তুরস্কে) যুদ্ধ থেকে। দীর্ঘদিন ট্রয় অবরোধ করে রেখেও গ্রিকরা ট্রোজানদের পরাস্ত করতে পারেনি। শেষে নতুন কৌশল করল তারা। অবরুদ্ধ নগরীর ফটকের বাইরে বিশাল কাঠের ঘোড়া তৈরি করে রেখে তারা ভান করল যে তাদের নৌবহরে চড়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে। ট্রোজানরা ভেবেছিল গ্রিকরা কাঠের ঘোড়াটা তাদের জন্য উপহার রেখে গেছে। বিশাল সে ঘোড়া টেনে তারা নগর প্রাকারের ভেতরে নিয়ে এলো এবং উত্সবে মেতে উঠল। রাতের আঁধারে গ্রিকরা ফিরে এলো। কাঠের ঘোড়ার পেটে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যরা নেমে ফটক খুলে দিল। ঘুমন্ত ট্রোজানদের কচুকাটা করেছিল গ্রিকরা। 
ভারতের ঋণদান চুক্তিও সব সময় নিরাপদ মনে করা যাচ্ছে না। যে ‘দয়া-দাক্ষিণ্য’ তারা দেখাতে এগিয়ে এসেছে, সেটাও শাঁখের করাতের মতো — যেতেও কাটে আসতেও কাটে। প্রণব মুখার্জী ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিলেন ১.৭৫ শতাংশ সুদে। নতুন প্রস্তাবিত ঋণের জন্য সুদ দিতে হবে লন্ডনের লাইবর (আন্তঃব্যাংক লেনদেনের সুদের হার) সুদের চাইতে ২.৫ শতাংশ বেশি সুদে। লাইবর সুদের হার বর্তমানে দুই থেকে আড়াই শতাংশ। অর্থাত্ নতুন ভারতীয় ঋণের জন্য বাংলাদেশকে সাড়ে চার থেকে পাঁচ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, অতীতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ পেয়েছে এক শতাংশেরও কম হারের সুদে, সাধারণত ০.৭৫ শতাংশ হারে। শেখ হাসিনার সরকারের ‘দুর্নীতির সমাজতন্ত্র’, পদ্মা সেতু দুর্নীতির হোতাদের শাস্তি দিতে অনিচ্ছা এবং ঝগড়াটে নীতি ও আচরণের কারণে ওই দুটি বিশ্ব সংস্থা এখন আর বাংলাদেশকে ঋণ দিতে এগিয়ে আসে না।
রেমিট্যান্সের দুরবস্থার কারণও এই সরকারের ভ্রান্ত পররাষ্ট্র নীতি। বাংলাদেশ থেকে সর্বাধিক শ্রমিক নিয়োগ করত মূলত উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলো। হাসিনা সরকারের ইসলামবিরোধী নীতির কারণে এসব দেশের সরকার বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ অথবা হ্রাস করে দিয়েছে। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিদেশি রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্স ছিল এ দেশটি। কিন্তু আমিরাত এখন সরকারিভাবে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে দেশটি। এমনকি এখন থেকে আমিরাত আর কোনো বাংলাদেশীকে ট্রানজিট ভিসাও দেবে না। আমিরাত সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, নেপাল থেকে তিন লাখ শ্রমিক নিয়োগ করে বাংলাদেশী শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবে। 
আমিরাতের এই কঠোর অবস্থানের কারণ খুবই স্বচ্ছ। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল কয়েকটা দেশ। দুবাই আর রাশিয়া তাদের অন্তর্ভুক্ত। বিদেশে বর্তমান সরকারের বন্ধু নেই একমাত্র ভারত ছাড়া। শেখ হাসিনা বন্ধুর সন্ধান করছেন সাবেক সোভিয়েট ব্লকে ভারতের পুরনো মিত্রদের মধ্য থেকে। দৃষ্টান্ত হচ্ছে, গতবছর হাসিনার মস্কো ও বেলারুস সফর এবং সে দুটি দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি। বাণিজ্য মেলার জন্য সরকার আমিরাতের পরিবর্তে সমর্থন দিয়েছে রাশিয়াকে। বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে আমিরাত এখন প্রতিশোধ নিল। 
সার কথা হচ্ছে, ভারতের প্রস্তাবে সরকার যতই ‘বিস্ময়‘ প্রকাশ করুক শেষ পর্যন্ত কয়েক গুণ বেশি হারের সুদে সে ঋণ গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হবে। বাংলাদেশের মানুষের মাথা বন্ধক রেখে দেশের স্বার্থবিরোধী এসব কাজ করতে সরকার বাধ্য হচ্ছে এ কারণে যে, দেশবাসীর সমর্থনবিহীনভাবে তারা গদিতে থাকতে চায়। ভারত সে ব্যাপারে তাদের সব রকমের সাহায্য দিচ্ছে, কিন্তু সে সাহায্য শর্তহীন নয়। বিনিময়ে তারা সর্বাধিক সুবিধা আদায় করে নেবেই। 
দূর মেয়াদে ভারত লাভবান হবে না
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভারতও হাসিনার সরকারের সঙ্গে অন্যায্য চুক্তিগুলো থেকে খুব বেশি লাভবান হবে না। এই সরকার শুধু নতজানুই নয়, ষাষ্টাঙ্গে উপুড় হয়ে আছে ভারতের কাছে। সে সুযোগে ভারত ট্রানজিট আদায় করে নিচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কন্টেইনার ট্রেনে অস্ত্র পাঠাবে উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যেও (সাত বোন) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এসব কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের নিত্যনতুন ক্রোধের কারণ সৃষ্টি করে যাচ্ছে দিল্লির সরকার। দেশের মানুষের ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে রেখে কন্টেইনার ট্রেনগুলো যে নিরাপদে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলোতে যাবে তার নিশ্চয়তা দেবে কে? তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ট্রানজিট ট্রেন কিংবা লরিতে হামলা করাওসাত বোনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যাতীত নয়।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শেখ হাসিনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে তারা স্বাক্ষর করতে পারলেন না বলে। বাংলাদেশের মানুষ কি খুশি হবে তাতে? আনন্দে হাততালি দেবে? বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে অভিন্ন নদীগুলোর অবাধ স্রোত এ দেশের অস্তিত্বের ব্যাপার। ফারাক্কায় ভারত বাঁধ তৈরি করেছিল পদ্মার স্রোত পরিবর্তন করে ভাগিরথী দিয়ে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু সে চুক্তি অনুযায়ী পানি বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি। তার পর থেকে অভিন্ন নদীগুলোর তাদের দিকে অন্তত ৩৫টি বাঁধ ভারত তৈরি করেছে বাংলাদেশের পানির হিস্যা কেড়ে নেয়ার জন্য। রাজনৈতিক সমস্যা-সঙ্কটে জর্জরিত বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টি সেদিকে গেছে টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে। বাংলাদেশের মানুষ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, কেননা টিপাইমুখ সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকাকে মরুভূমিতে পরিণত করবে। আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ইলিয়াস আলী সেই যে ২৩ মাস আগে গুম হয়ে গেছেন, আজ অবধি তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এখন আবার খবর পাওয়া গেছে, ভারত অভিন্ন নদীগুলোর পানি উষর মধ্যভারতে নিয়ে যাওয়ার পুরনো পরিকল্পনাটির কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ পরিকল্পনায় সব নদীর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে পানি সুদূর মধ্যভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। তাতে মধ্যভারতের মরুভূমি সুজলা-সুফলা হবে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তার প্রতিক্রিয়া কী হবে? শুধু তিস্তা কিংবা সুরমা-কুশিয়ারাই নয়, কোনো নদী দিয়েই আর যথেষ্ট পানি বাংলাদেশে আসবে না। অথচ মনমোহন সিং ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১১ সালে ঢাকায় এসেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করবেন বলে।
আন্তর্জাতিক চুক্তির অবমাননা
শুধু পানির ব্যাপারেই নয়। ভারতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। দু’দেশের সীমান্ত সহজীকরণ ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে। শেখ মুজিব কালবিলম্ব না করে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী পাস করেন এবং বেরুবাড়ী ছিটমহলটি ভারতের হাতে তুলে দেন। কিন্তু ভারত আজ পর্যন্ত সে চুক্তি অনুমোদন করেনি, তিনবিঘা ছিটমহলটি আজও বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে পবিত্র জ্ঞান করা বিশ্বসভ্যতার অন্যতম খুঁটি। দেখা যাচ্ছে ভারতে নয়, দেশে দেশে চুক্তি যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ এখন সঙ্গতভাবেই বলতে পারবে, গণবিচ্ছিন্ন হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারত যেসব চুক্তি করেছে সেগুলো মেনে চলতে তারা বাধ্য নয়। 
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে, একটা অনির্বাচিত অবৈধ সরকারকে গদি আঁকড়ে থাকতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র তাদের একজন কূটনীতিকের কৃত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিল। ভারতজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে তাতে। এদিকে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে, তার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে অহরহ হস্তক্ষেপ করেছে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে। সরকারিভাবেই তারা এক হাজার কোটি রুপি ব্যয় করেছে বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ সে নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ সংসদ সদস্যকে ভোটের তারিখের আগেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতে নির্বাচন শুরু হচ্ছে কয়েকদিন পরেই। ভারতের জনতা কি সে নির্বাচনে অন্য কোনো দেশের সামান্যতম হস্তক্ষেপও সহ্য করবে? ভোটারবিহীন নির্বাচন ভারতে হলে সে দেশের জনতা কি পথে নামবে না? বিপ্লব হয়ে যাবে না ভারতে? অথচ শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখার জন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা বিশ্বব্যাপী তদবির করে বেড়াচ্ছেন। 
খালেদার আহ্বানে সাড়া দিন
ভারত সরকার, বিশেষ করে ভারতের মানুষ একটা কথা মনে রাখতে পারে। বিগত পাঁচ বছর আড়াই মাসে দিল্লির সরকার বাংলাদেশে যা করেছে, সেটা দু’দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কে একটা দুষ্ট ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যতই দিন যাবে সে ক্ষতের পচন ততই মারাত্মক ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। তাদের নামে দিল্লির গণবিচ্ছিন্ন সরকার যা করেছে, তার সঠিক চিত্র জানতে পারলে ভারতের জনসাধারণও নিশ্চয়ই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মানুষ মনে-প্রাণে বন্ধুত্বের ও সহযোগিতার সম্পর্কই চায় ভারতের সঙ্গে। কিন্তু বন্ধুত্ব কখনোই একতরফা হতে পারে না। দিল্লির বর্তমান সরকারের নীতি হচ্ছে তারা কেবলই নিতে চায়, বিনিময়ে কানাকড়িও তারা দেবে না। 
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রকাশ্যেই বলেছেন, জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের মানুষকে ভারতবিমুখ করে তুলছে। হয়তো তার সরকারের উসকানিতেই শেখ হাসিনার সরকার জামায়াতের এবং সাধারণভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে। কিন্তু তার পরিণতি কী হয়েছে সাধারণ নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতের ভোটদাতাদের সেটা জানা প্রয়োজন। সাদা চোখেও দেখা যাবে, বিগত পাঁচ বছরে জামায়াতের শক্তি ও সমর্থন অনেক বেড়ে গেছে। দফাওয়ারিভাবে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে, তাতেও প্রমাণ হয়ে গেছে, জামায়াত এখন আওয়ামী লীগকে ছুঁই ছুঁই করছে। আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক গুণ্ডামি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস না হলে জামায়াত আওয়ামী লীগের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। সাধারণভাবেই বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক বেশি ইসলামী ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। হাসিনার সরকারের চরম নির্যাতন ও দমননীতি সেকুলার বাংলাদেশকে ইসলামী মৌলবাদের দিকে অনেকখানি ঠেলে দিয়েছে।
কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিন বারের প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানেও বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় জননেত্রী খালেদা জিয়া যথার্থই বলেছেন, ভারতের বর্তমান সরকার বাংলাদেশের মানুষকে বন্ধুত্বের পরিবর্তে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শেখ হাসিনার অবৈধ সরকারকে সমর্থন দান বন্ধ করতে তিনি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন। বস্তুত দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এ পথেই — একে অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার শর্তে। খালেদা জিয়া জানেন এবং ভারতের মানুষ আরও বেশি করে জানে, দিল্লির বর্তমান সরকারের আয়ু হয়তো আর বেশি দিন নয়। এপ্রিল-মের সাধারণ নির্বাচন সব কিছু ওলোট-পালোট করে দিতে পারে। সেজন্য এটা মনে করাই সঠিক হবে যে বেগম জিয়া প্রকৃতপক্ষে তার আকুল আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের ভোটারদের উদ্দেশে। লোকসভার নির্বাচনে ভোট দেয়ার সময় ভারতীয় ভোটাররা সে আহ্বানের কথা মনে রাখলে দু’দেশেরই কল্যাণ হবে। (লন্ডন, ১৮.০৩.১৪)

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!