সেনা সদরের সংবাদ সম্মেলন: মব ভায়োলেন্স ও জননিরাপত্তা বিঘ্ন করলে সেনাবাহিনী কঠোর হবে

ক্যাপ্টেন (অবঃ) মারুফ রাজুঃ  সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের বিরোধ বা মুখোমুখি অবস্থান নেই। বিভেদ কিংবা দ্বন্দ্ব কিছুই সৃষ্টি হয়নি। একে অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে কাজ করছে। যেভাবে বাইরে বলা হচ্ছে, সেটি অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। শনিবার রাজধানীর ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনা সদর দপ্তর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের নির্দেশ মেনেই কাজ করছে সেনাবাহিনী। আগামীদিনে বিন্দু পরিমাণ শক্তি থাকা পর্যন্ত দেশকে রক্ষা করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্ত যে কোনো সময়ের চেয়ে সংবেদনশীল। তবে পুরো পরিস্থিতির ওপর গভীরভাবে নজর রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ চলছে। মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, দেশের স্বার্থ বিনষ্ট হয়-এমন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবে না সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, কোনো দেশ থেকে পুশইন কাম্য নয়। এটি প্রতিরোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কাজ করছে। প্রয়োজনে সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনী যুক্ত হবে। এ সময় স্পষ্টভাবে জানানো হয়, মব ভায়োলেন্স ও জননিরাপত্তা বিঘ্ন করলে সেনাবাহিনী কঠোর হবে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনাবাহিনীর এক সভায় (অফিসার অ্যাড্রেস) বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। এরপর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে সোমবারের ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সেনাপ্রধান এ ধরনের কথা বলেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ধরনের গুজব ছড়ানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই দেশ আমাদের সবার। সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরও। তাই সীমান্তে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করব না। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা মেনেই কাজ করছি। সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো মতপার্থক্য হয়নি। একসঙ্গে কাজ করাই লক্ষ্য। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল-সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধান নির্বাচন, মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেওয়া এবং বন্দর নিয়ে অভ্যন্তরীণ সভায় বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে সরকার এবং সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। এ ব্যাপারে আপনাদের ব্যাখ্যা কী? জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘যেভাবে কথা আসছে, সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিশাল মতপার্থক্য হয়েছে, বিভেদ রয়েছে, মিডিয়ায় বিষয়টি যেভাবে আসছে, এরকম আসলেই কিছু হয়নি। আমরা একে অপরের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সুন্দরভাবে কাজ করছি। এটা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়গুলো জটিলভাবে চিন্তা না করে সহজভাবে ভাবতে হবে। আমরা যেন বিষয়টিকে এমনভাবে না দেখি যে সরকার ও সেনাবাহিনী ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করছে। সরকার ও সেনাবাহিনী একসঙ্গে কাজ করছে। ভবিষ্যতেও আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাব।’ সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিন্দু পরিমাণ শক্তি থাকতে সার্বভৌমত্বে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। যে কোনো মূল্যে আমরা দেশকে রক্ষা করব।

নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের অবস্থান সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, অফিসার্স অ্যাড্রেস অফিসারদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রেগুলার রুটিন। সেনাপ্রধান এ ধরনের অনুষ্ঠানে দিকনির্দেশনা নিয়মিত দেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে বিদেশি নাগরিকদের পুশইনের বিষয়ে সেনা সদর বলছে, পুশইন কাম্য নয়। এটি প্রতিরোধে এখন বিজিবি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কিন্তু প্রয়োজন হলে সরকারের নির্দেশনায় সেনাবাহিনী যুক্ত হবে। এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, সেনাবাহিনী মনে করে, পাহাড়ের আত্মস্বীকৃত সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক এবং তাদের নির্বাচনে আনা উচিত হবে না। একটি গার্মেন্টে কুকি-চিনের ৩০ হাজার ইউনিফর্ম পাওয়া গেছে। এমন সংবাদকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সেনাবাহিনী। এছাড়া ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে যাতায়াত নিশ্চিত করতে ঈদের আগে ও পরে ২ সপ্তাহে সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল পরিচালিত করবে। এর মধ্যে গাড়ি চলাচলের গতি, টিকিট কালোবাজারির মতো বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারি রাখবে। কুরবানির পশুর হাটে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণেও সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল পরিচালনা করবে। এ সময় স্পষ্টভাবে জানানো হয়, মব ভায়োলেন্স ও জননিরাপত্তা বিঘ্ন করলে সেনাবাহিনী কঠোর হবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে, এটি গুজব। এর কোনো ভিত্তি নেই। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। এমনকি এ বিষয়ে আমাদের ভেতরেও কোনো আলোচনা হয়নি।

এদিকে অপর এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘লালমনিরহাট বিমানবন্দর অনেক পুরোনো। এখন প্রয়োজনের নিরিখে সেটিকে আবার সচল করা হচ্ছে। ওখানে একটা এরোস্পেস ইউনিভার্সিটি হবে। এভিয়েশনের কর্মকাণ্ড প্রসারিত হবে। উত্তরটা এটার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ এতদিন প্রয়োজন হয়নি, ফলে ব্যবহার হয়নি। এখন প্রয়োজন পড়েছে, ফলে ব্যবহারের জন্য সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু চীন এই বিমানবন্দর ব্যবহার করবে কি না, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়-এরকম কোনো কর্মকাণ্ডে কোনো দেশকে অনুমতি দেওয়া হবে কি না, নিশ্চয়ই সরকার সেটা ভেবে দেখবে।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৯ মাসে সেনাবাহিনী ৯ হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র ও ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এছাড়াও গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১ হাজার ৯৬৯ জনকে এবং এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৬৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। এ সময় আরও বলা হয়, জুলাই আন্দোলনে সেনাবাহিনী ৪ হাজার ৫৯৬ জনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছে। এখনো ৩৬ জন চিকিৎসাধীন।

Share this post

scroll to top