ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এখন ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি তৈরি হচ্ছে ‘দুর্নীতির প্রয়োজনে’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে নীতি তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতি করার জন্য। দুর্নীতি এখন আমাদের সিস্টেমে (ব্যবস্থাপায়) যুক্ত হয়ে গিয়েছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন এ ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘‘রাজনীতি অর্থনীতি; বাংলাদেশ এখন’’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এমন কথা বলেন।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরো বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্কটা কেমন হয়েছে তার একটি বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। আমরা শুনে থাকি উন্নয়ন হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। এমন কথাও প্রচলন আছে মাঠে যে, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি কিছুটা হবে। কিন্তু দুর্নীতি এখন আমাদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে গেছে।’
দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতা না থাকা। সরকার ও প্রশাসনে জবাবদিহিমূলক আচরণ অনুপস্থিত হওয়ার কারণ হচ্ছে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শুধু ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নয়, অতীতের ধারাবাহিকতায় দেখেছি নির্বাচনী ভোটটা অনুপস্থিত হয়ে গেছে।’
যশোরের হাইটেক পার্ক এখন কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ভাড়া দিতে হচ্ছে মন্তব্য করে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে উন্নয়নের অর্থায়নটা ঋণ নির্ভর হয়ে গেছে। উন্নয়ন খরচের অদক্ষতা অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে ঋণ নির্ভর উন্নয়ন আমাদের ব্যবস্থাপনায় একীভূত হয়ে গেছে। আর অদক্ষতা ও জবাবদিহিতায় ধস নেমেছে, দুর্নীতি করাটা আমাদের সিস্টেম (ব্যবস্থাপনায়) যুক্ত হয়ে গেছে। তৃতীয়ত ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। নীতি তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতি করতে। এভাবে দুর্নীতি করা হচ্ছে।’
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি করছে, ধরা পড়লেও তাদের বিচার হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আপনি দুর্নীতি করছেন সমস্যা নেই। বলা হচ্ছে, আর করিস না। এভাবে দুর্নীতি আমাদের সিস্টেমে একীভূত হয়ে গেছে।’
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এগুলো অদক্ষ অর্থনীতির কু-শাসন। এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরির আভাস দেখতে পাচ্ছি। আর্থিক হিসাবে কিন্তু ঘাটতি এখনো আছে। কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষিত যুবকেরা দেশ ছাড়ছে। এতে ব্রেইন ড্রেন (মেধা পাচার) হচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সময়ে এটি কাঙিক্ষত না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা সবকিছু করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের ব্যক্তিরা শিক্ষক হতে আবেদন করার সাহস পাচ্ছে না। গত ১৫ বছরে ৯০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সরকারি মতাদর্শের। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কেমন তা সহজেই বুঝা যায়।’
অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো এক এক করে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার আইয়ুব খানের নীতিতে চলছে। আইয়ুব খান বলেছিলো, উন্নয়নকে এগিয়ে দেই-গণতন্ত্রকে একটু ধীর করে দেই। এখন সরকার বলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে রাজনৈতিক অধিকারের প্রয়োজন থাকবে না। এজন্য সরকার অবকাঠামোগত দিকেই যাচ্ছে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও অনেক দেশ করেছিল। এজন্য সরকার বলছে, দেশ সিঙ্গাপুর হবে, তা তো হয়নি। গত সাত জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখন দেশ ফ্রাঙ্কানাইন স্টাইলের যাচ্ছে। দেশে এখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতির ক্ষয় চলবে।’
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী লেখক আলী রিয়াজ বলেন, ‘ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হচ্ছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওয়ামী লীগ নিজ দলের আদর্শে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনার বাইরেও বড় একটি ঘটনা ঘটেছে, তা হলো ক্ষমতায় বহিঃশক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করি।’
‘বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে অভাবনীয় ক্ষমতা দিয়েছে। এক ব্যক্তির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় এক ব্যক্তি দলে দীর্ঘদিন প্রধান থাকছেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অর্থনীতি একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে তা সাধারণ মানুষও বুঝে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের দায়-দেনা বড় আকারে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতিতে। বৈদেশিক ঋণ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে। এটি বিনিময় হারের উপর চাপ তৈরি করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদ (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের উপর। যেভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, আয় বৈষম্য বাড়ছে তাতে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ছে। এর কারণ হিসেবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মধ্যে উন্নয়ন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে সবখানে। তারা এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কু-প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের মোকাবিলা করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি দরকার তা দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সরকারেও তা হচ্ছে না।’
এর সমাধানে শুধু সমালোচনা করলেই হবে না মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিকদের দুর্ভাগ্য হলো একটি গণতান্ত্রিকহীনতা ও কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বের হতে কি উপায় আছে তা বিরোধী রাজনৈতিক দল বলছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা একদিকে একটা গণতন্ত্রহীনতার ভিতরে তথাকথিত উন্নয়নের মধ্যে রয়েছি। অন্যদিকে এর কার্যকর বিকল্প হিসেবে আমাদেরকে আস্থায় নিতে পারছে না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘সুশাসনের অভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো একটি গোষ্ঠী ছিনতাই করে নিচ্ছে। তাদের সুবিধা মতো করছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু করতে পারছে না, এটা সত্য। এজন্য অতীতের মতো সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের ভূমিকা রাখা দরকার।’
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ ও মুখ্য সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে আমাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে। এখন ভর্তুকির ৮১ শতাংশই দেওয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জে, এটি তো দুর্নীতি। ব্যবসায়ী শ্রেণি এখন ব্যাংক খাতে লুটপাট করছে। তারা অর্থপাচার করছে তাদের কিছুই হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। স্থানীয় নির্বাচন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বর্জন করছে। তারা কেনো করছে এটি, স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তো পুরো নির্বাচন থেকে দলগুলো সরে যাবে।’
সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকায় মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এক হচ্ছে না। শুধু বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ নিয়ে একটি নিরাপত্তা দিতো, অর্থনীতির বাকি সূচকগুলো নিয়ে নীরব থাকতো, পথের বাধাগুলো সরিয়ে দিতো তাহলে সব ঠিক হয়ে যেতো।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারকে অর্থনীতির সমালোচনাকে গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে আছে। এতে অর্থনীতির নীতি ভারসাম্য ঠিক থাকতো। বাজারকে অষ্ট্রেপৃষ্টে বেঁধে কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়া দিলে তো হবে না।’