DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সিন্ডিকেট তত্ত্ব: আবদুল আউয়াল মিন্টু

বাংলাদেশে খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের খবর অনেকটাই স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত। অনেক মাধ্যম সত্য ঘটনাকে এঁকিয়ে বেঁকিয়ে, এঁচিয়ে-পেঁচিয়ে উপস্থাপন করে, আসল সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না। তারপরও এই “মাসতুতো ভাই সিন্ডিকেট “গোষ্ঠী” টেন্ডারে নিজ ইচ্ছেমতো মূল্য বাড়িয়ে কাজ বাগিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না।

অনেক সময় কাজ না করেও ভুয়া বিল জমা দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিতে পারে। এর অর্থ সরকার অনেক খাতে অঢেল পরিমাণে খরচ করলেও কাজ হয় নামমাত্র। অর্থাৎ “কাজীর গরু খাতায় আছে, কিন্তু গোয়ালে সব হিসাবে মেলে না।”

আমি পুনর্ব্যক্ত করছি- পুকুর চুরির মাধ্যমে জনগণের যে অর্থ লোপাট করা হচ্ছে সেই টাকা, ভোটারবিহীন বা ভোট চুরির মাধ্যমে নির্বাচিত দাবিদার অসাধু জনপ্রতিনিধি, দলবাজ অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং সরকার সমর্থক বায়ুবীয় ব্যবসায়ী, যাদের দুই হাত ও এক পা বিদেশে, তারা সবাই এই লুটের টাকা ভাগ করে নেয়।

ইদানিংকালে প্রহসনের নির্বাচনে যারা ক্ষমতাসীন দলের পুনঃমনোনয়ন পেয়েছে তাদের পূর্বের ও বর্তমান হলফনামার বিচার-বিশ্লেষণ করলে উপরোক্ত বাক্যগুলোর কিছুটা হলেও সত্যতা মিলবে। এখানে সেখানে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও ব্যতিক্রম কোনো বিধি-বিধান নয় (exception is not the rule)।

বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রায় সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মালিকেরা কোনো না কোনো সিন্ডিকেটের সদস্য। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় খবর নিয়ন্ত্রিত রাখা সত্ত্বেও প্রতিদিন টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দুর্নীতির অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এই খবরগুলোর মধ্যে কিয়দাংশ আবার মালিকরা নিজেই একে অপরের বিপক্ষে বলতে বা লিখতে প্রভাবিত করে।


এতদসত্ত্বেও দৈনিক পত্রিকার শিরোনামগুলো দেখলেই পাঠক বাংলাদেশে বর্তমানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ব্যাংক লুট ও দুর্নীতির যে মহোৎসব চলছে তার বাস্তব ও খোলামেলা চিত্র পাবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তাদের এই লুটপাট কেবলমাত্র সরকারি ব্যয়ে জঘন্য নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অর্থনীতির তত্ত্বানুযায়ী এসবই অর্থনীতির অংশ। অতএব বলা যায় যে, দুর্নীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজি বা আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনার ফলে পণ্যসেবা ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও অর্থনৈতিক সমস্যার বাইরে নয়। সত্যিকার অর্থে, এসব কার্যক্রমের পরিণতি হিসাবে দেশ, সমাজ, দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির মূল ভিত্তিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলেছে। যা দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিয়েছে।


জনতুষ্টির নামে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসন
এ ধরনের চুরি, লুটপাট, রাজস্ব অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার বীজ পরিলক্ষিত হয়েছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে। ওই সময়কালে পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন, দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা (হুয়ান পেরন) ও পেরুতে (মোরালেস), আফ্রিকার কঙ্গো ব্রাজাভিলে (মুবুতে সেসে সেকো) বা সমসাময়িককালে ফিলিপিন (মার্কোস), ইয়োগাস্লাভিয়া (টিটো), ভেনিজুয়েলায় (শ্যাভেজ), জিম্বাবুয়ের (রবাট মুগাবে) বা ৮০ এর দশকে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আলবেনিয়া ও সুদানের স্বৈরশাসকদের শাসনামলে। বর্তমানে একই চরিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, নিকারাগুয়া, হাইতি, গুয়াতেমালা, মিশর, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশে।

১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক বেষ্টনীর লেবাসের আড়ালে বিশ্বের বহু দেশে একনায়কতান্ত্রিক নেতারা এক ধরনের তথাকথিত কল্যাণমুখী “জনতুষ্টি (Populist) শাসনের নীতি” কায়েম করে। ওই শাসন ব্যবস্থার লেবাসের আড়ালে, মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন। ফলস্বরূপ ওইসব দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের কাছাকাছি চলে যায়। যদিও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং বেশ সম্পদশালী ছিল। কিন্তু জনতুষ্টি শাসনের লেবাসে স্বৈরতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে তারা দেশের সমাজ ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সমাজে উপরের স্তরে দেখলে সব শান্ত মনে হলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেশগুলোকে দুর্দশাগ্রস্ত করে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। যার কারণে ওইসব দেশে আজও সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতার রেশ কাটেনি। দেশগুলো এখনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হোঁচট খাচ্ছে। ফলে দীর্ঘ পাঁচ দশক পরও এই দেশগুলো এখনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বংসাবশেষের রেশ টানছে।


সিন্ডিকেট তত্ত্ব
এসব একনায়কতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসকরা অল্প কিছুকালের জন্য জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। জনপ্রিয়তা ও পরিচিতির কলেবর বৃদ্ধি এবং ক্ষণস্থায়ী কৃত্রিম জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য তারা এক নতুন শাসন ব্যবস্থা বা নীতি অনুসরণ করেছিলেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সুযোগে ওই দেশগুলোতে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ আমলা, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বায়বীয় (টুকটাক) ব্যবসায়ী ও সুযোগসন্ধানী পেশাজীবীরা একত্রে মিলে-মিশে নতুন নতুন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। ওই গোষ্ঠী সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে অবাধে দেশের সম্পদ লুটপাট করার সুযোগ পায়। ব্যবসার নামে লুটপাট করতে তাদের কোনো বাধা ছিল না। অতি দ্রুত তারা ধনী বনে যান। এই গোষ্ঠী অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় সম্পদ করায়াত্ত করার লক্ষ্যে, যথেচ্ছভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করার অবাধ সুযোগ পায়। সেই সুযোগে এইসব গোষ্ঠীর সদস্যরা দেশের প্রশাসন বা দেশ শাসনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তারা আইনের শাসনের (Rule of Law) পরিবর্তে আইন বা বিধিবিধানের দ্বারা (Rule by Law) শাসন চালু করে।


অন্যদিকে নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তথাকথিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আমলারা একত্রে মিলেমিশে, যোগসাজশের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারও খালি করে দিয়েছিল। ফলে একদিকে পণ্য ও সেবা ক্রয়ে সরকারি খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে রাজস্ব আয় কমে যায়। অতিরিক্ত দেশি-বিদেশি ঋণ নেয়া ছাড়া সরকারের খরচ নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চালু রাখতে ও দলীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে দুর্নীতিতে সহায়তা করার লক্ষ্যে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়। ফলে সরকারের খরচ ও ঋণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়।

প্রহসনের নির্বাচন, আইনের শাসনের পরিবর্তে বিধিবিধানের শাসন, স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রীতি ও নীতি এবং দুর্নীতির ফলে সাংবিধানিক ও আইনের বলে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠী সহজেই এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন- সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ, আমলাতন্ত্রকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসে। বলা যায় নিজেদের করায়াত্তে নিয়ে আসে। ফলে এসব পথভ্রষ্ট স্বৈরশাসকদের বেআইনি কর্তৃত্বে বাধা দেয়ার জন্য কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বা বিরোধী দল টিকে থাকতে পারে নাই। নামেমাত্র বিরোধী দল থাকলেও, অনেকটাই বর্তমান বাংলাদেশের গৃহপালিত বিরোধী দলের মতো। নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হতো বিধায় বিরোধীরা রাজপথে সরব থাকলেও সংসদে ছিল যৎসামান্য। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতারাই ছিল ভোটচুরির সর্দার। তাই সংসদে এইসব স্বৈরশাসকদের কখনো শক্তিশালী বিরোধী দলের সম্মুখীন হতে হয়নি। অনুররূপ নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধীদের নির্মূল করার লক্ষ্যে যে কয়েকটি দেশ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কুখ্যাতি লাভ করেছে- এগুলোর প্রথম সারিতে হলো- নিকারাগুয়া, হাইতি, গুয়াতেমালা, মিশর, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ।

সামাজিক বেষ্টনীর লেবাস─ সামাজিক ও আয়ের বৈষম্য
এসব স্বৈরশাসকদের সমর্থকদের মধ্যে বৃহদাংশ ছিল গরিব ও দুর্বল। তাদের লুণ্ঠন করার শক্তি ও সামর্থ্য ছিল না। তাদের লাগাতার সমর্থন ধরে রাখার জন্য এবং সাধারণ জনগণকে পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে, সামাজিক বেষ্টনীর নাম করে বিভিন্ন চমকদার ও চটকদার ‘কল্যাণমুখী’ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যেমন বাংলাদেশে সবার জন্য ঘর, একটি বাড়ি-একটি খামার, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সর্বজনীন পেনশন, বিনামূল্যে চিকিৎসা, ঘরে ঘরে চাকরি এবং বিভিন্ন ধরনের ভাতা। এসবের কোনো সমভিত্তিক বণ্টন হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার সমর্থকরা এসবের দানগ্রহীতা বা স্বত্বভোগী। যেমন- আজকাল অনেক নৌকা মার্কা মনোনীত প্রার্থীর লেন্সারদের (বল্লমধারী সৈনিক) মুখে শোনা যায় যে “নৌকায় ভোট না দিলে ভাতা পাওয়ার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে দেবে।” এসবের আসল উদ্দেশ্য হলো সরকার সমর্থকদের তুষ্ট রাখা ও তাদের সমর্থন ধরে রাখা। এগুলোর প্রায় সবই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। ফলে ভর্তুকির কলেবর অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। সমাজে দুর্নীতি দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে। গরিবের সম্পদ চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি কোষাগার থেকে লুণ্ঠন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাতে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য বহুলাংশে বেড়ে যায় ও সর্বজনীন নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে।

অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি, বাণিজ্যিক ঘাটতি, বিদেশের সঙ্গে লেন-দেনের চলতি হিসেবে ও দায়স্থিতির ঘাটতি বেড়ে যায়। দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। মুদ্রা পাচার বেড়ে যায় ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে। এগুলো সব মিলেমিশে মূল্যস্ফীতির অন্তঃস্থলকে উস্কে দেয়। একইসঙ্গে এই ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করার কারণে মূল্যস্ফীতির হার ব্যাপক আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় ওইসব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আইএমএফ’র হস্তক্ষেপ বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। ওই সময় অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ওইসব দেশে অর্থনীতির কাঠামো সমন্বয় (Structural adjustment) নীতি অনুসরণে বাধ্য করে। নীতি প্রক্রিয়া অনুসরণ বাধ্যতামূলক, ওই নীতি ক্রমান্বয়ে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস বা মতৈক্য’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে উপরোক্ত সমস্যাগুলো পুরোপুরি বিদ্যমান। অতএব আইএমএফ’র হস্তক্ষেপ কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক- পদ্ধতি ভিন্ন
বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের কর্তৃত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে বহুলাংশে ওইসব দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে ভিন্ন রাস্তা ধরে অনেকটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছে। সামাজিক বেষ্টনী, প্রকল্প আর প্রকল্প ও ভর্তুকির সঙ্গে যোগ করেছে মেগা প্রকল্প। অর্থাৎ “গরিব ও দুর্বলদের লোক দেখানো তুষ্টির আড়ালে, অবৈধ উপার্জনকারী ধনী লুটেরা গোষ্ঠীকে আরও লুট করার সুযোগ দিয়ে তুষ্ট করা।” এসব মেগা প্রজেক্ট দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সহায়ক হলেও আসলে এগুলোর সত্যিকারের উদ্দেশ্য হলো মেগা দুর্নীতি।” অর্থাৎ অতি অল্প সময়ে বেশি মাত্রায় দুর্নীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করা। এক কথায় দ্রুতগতিতে কোষাগার লুণ্ঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন সিন্ডিকেট সদস্যদের ধনী বানিয়ে দেয়া। এসব মেগা প্রজেক্ট করতে গিয়ে সরকার কর্তৃক অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নিতে যেন অসুবিধা না হয় সেজন্য জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানো, জিডিপি’র তুলনায় ঋণ কম দেখানো, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে দেখানো ইত্যাদি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের বিকৃতিকে সচরাচর রীতিনীতি বানিয়ে ফেলেছে।

এসব বিভ্রান্তিমূলক লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারি খাতে স্বল্প মেয়াদের বৈদেশিক ঋণ নিতে উৎসাহ যোগানো হয়। একই সঙ্গে দেশের সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ডাকঢোল পিটিয়ে ইতিহাসকে রূপকথায় রূপান্তরিত করে ফেলেছে। অপরদিকে বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মামলায় কোটি আসামি করেও এই সরকার শান্তি পাচ্ছে না। তাই এখন রাত্রে আদালত বসিয়ে রকেটের গতিতে ওইসব সাজানো ও মিথ্যা মামলায় ফরমায়েশি সাজা দেয়া হচ্ছে। সমস্যা হলো তাতে কি অবৈধ সরকারের গায়ে সুবাতাস লাগবে। মনে শান্তি আসবে। আমার বিশ্বাস তারা নিজেদের মনে, নিজেদের দলে ও দেশে অশান্তি বাড়াচ্ছে এবং অচিরেই হয়তো বা এসবের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবে। তাই হয়তো এত ভয়।
বেসরকারি খাত কর্তৃক নেয়া বৈদেশিক ঋণ একদিকে স্বল্প মেয়াদি, আবার অন্যদিকে সুদের হার অনেক বেশি। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি; স্বল্প-মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, দেশ এখন পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। লুটেরা গোষ্ঠীর কারসাজিতে সরকারের রাজস্ব আয় জিডিপি’র তুলনায়  কমে গেছে। সম্ভবত এশিয়া মহাদেশে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা ও ঋণ শোধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ট্রেজারি বিল, বন্ড ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ক্রমাগত ঋণ নিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে নিজেদের আন্তঃকোম্পানি দায়-দেনা বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে। যেমন পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল ও গ্যাস উৎপাদন বা আমদানি করে বিপিডিবি বা বিসিসিআইকে বাকিতে বিক্রি করে। বিপিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের অন্য কোম্পানিকে বাকিতে দিচ্ছে। বিসিআইসি সার উৎপাদন করে বিএডিসিকে বাকিতে দিচ্ছে। বাকিতে দেয়া টাকার পরিমাণ এমন সংকটাপন্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সরকারি কোম্পানিগুলো একে অপরের পাওনা পরিশোধ করার আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এসবই দেশের অর্থনীতিতে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সিন্ডিকেট সদস্যদের অবদান। একই সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। মূলধন ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা যোগান দেয়ার কথা, তাতেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মোট কথা আর্থিক খাত ও  অর্থনীতিতে এক লেজে-গোবরে অবস্থা।

অর্থনীতি ─ চালক-পরিচালকদের দ্বিচারিতা
বর্তমান সময়ে অর্থনীতির সুচকগুলো শুধু যে নিম্নমুখী তা নয় বরং একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। এতদসত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে “সারা পৃথিবী এখন স্বীকার করে, বাংলাদেশ হলো রোল মডেল। অর্থনীতি আর কতো ভালো হবে।” তিনি আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশ নজিরবিহীন সুযোগের দেশ। এখানে বিনিয়োগ করে লোকসানের কোনো সুযোগ নেই” (প্রথম আলো- সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩)। এ ছাড়াও অপর এক সভায় বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তারপরও যারা বলেন দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, তারা অর্থনীতিই বোঝেনা” (বণিক বার্তা -সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩)। অথচ সম্প্রতি জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্টো) এক জরিপে বলেছে যে “বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ৭১ শতাংশ কোম্পানি সন্তুষ্ট নয়।” আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা এখন আর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, লজ্জা-শরমের ধার ধারে না।

অক্টোবর মাসের ৫ তারিখে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টি অনুষদ আয়োজিত বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স শীর্ষক সেমিনারে বলেছেন “আমাদের অর্থনীতি দুই ভাগে বিভক্ত- মানি মার্কেট এবং ক্যাপিটাল মার্কেট। মানি মার্কেট বাংলাদেশ ব্যাংক দেখভাল করে। আর ক্যাপিটাল মার্কেটের আওতায় প্রায় ১১০০ প্রতিষ্ঠান, যেখানে ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ফান্ড ম্যানেজার, মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ অনেক কিছু আমরা দেখি।” তিনি যদি “আর্থিক খাত” বলতেন তাহলে যথোচিত হতো। যাই হোক মূল কথা তিনি যা বলেছেন “আমি নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জগতকে অন্যরকম ভাবে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের অর্থনীতির জন্য আগামী পাঁচ বছর হবে গোল্ডেন ফাইভ ইয়ার্স অব ইকোনোমিক ডেভলপমেন্ট।” অতএব এই ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রিদের জন্য চাকরি, প্রমোটর হওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য করার একটা বিরাট সুযোগ আসছে।” অথচ দেশের বৃহদাংশ মানুষ যেমন অর্থনীতিবিদ, ছোট-মাঝারি-বড় শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা মনে করেন যে, “অর্থনীতির অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে।” এমতাবস্থায়, যিনি অর্থনীতির দুই ভাগের এক ভাগের তত্ত্বাবধানে আছেন বলে দাবি করেন তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেন, “আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য স্বর্ণালী যুগ।” অথচ উনি যে ১১০০ কোম্পানির কথা উল্লেখ করেছে এগুলোর বেশিরভাগ এখন বিভিন্ন শ্রেণিতে আবদ্ধ। যেমন লভ্যাংশ না দেয়ার ফলে “ত” ক্যাটাগরি, অথবা শেয়ারের আক্ষরিক মূল্য থেকে কমে যাওয়াতে সর্বনিম্ন বেঁধে দেয়া নিয়ন্ত্রণ মূল্যের আওতায় পড়ে আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এই “অদূরদর্শী চালকরা আজকাল তামাকেও সোনা হিসাবে দেখতে পাচ্ছে।” আর যাদেরকে এসব বুলি শেখাচ্ছেন তাদের ভবিষ্যৎই বা কী? বিএসইসি এর চেয়ারম্যানের ভাষ্যনুযায়ী অর্থনীতির বাকি অংশের দায়িত্বে হলো বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের রাজস্ব প্রতিনিধি বা ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি (নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে) এক সভায় বলেছেন, “দেশের অর্থনীতি একেবারে তলানীতে ঠেকেছে। আর নিচে নামার রাস্তা নেই। গত ৩৬ বছরের সরকারি চাকরি জীবনে অর্থনীতিতে এমন সংকটাপন্ন অবস্থা আর কখনো দেখিনি।” তবে তিনি এও বলেছেন যে, “এই সংকটের টানেলে তিনি আলো দেখতে পাচ্ছেন।” আলো দেখা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. বিরূপাক্ষ পাল (এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বর্তমানে আমেরিকাতে অধ্যাপনায় নিয়োজিত) প্রথম আলোতে এক নিবন্ধে (ডিসেম্বর ৬, ২০২৩) লিখেছেন “তার (গভর্নরের) দিব্যচক্ষুতে একক আলো-দর্শন অনেকটা আধ্যাত্মিক বাণীর মতো শোনাচ্ছে। এ যেন লালনের আখড়ায় শিক্ষালাভের প্রথম ধাপ, যেখানে গুরু সব দেখতে পান, অথচ শিষ্যরা কিছুই দেখে না।” তিনি আরও লিখেছেন “কোনো গবেষণা ছাড়াই এমন মন্তব্য করা অন্ধের হাতি দর্শনের সমতুল্য।”

যদি অর্থনীতি ও আর্থিক খাত নিয়ে বিভিন্ন নায়কের; যেমন অর্থমন্ত্রী, বিএসইসি এর চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মন্তব্যগুলো কেউ পর্যালোচনা করে তাহলে কারও বুঝতে বাকি থাকবে না যে, “এগুলো আগা থেকে গোড়া স্ববিরোধী।” অর্থাৎ তারা “জানে, বোঝে ও মনে ধারণ করে এক, কিন্তু জনগণকে বোকা বানাতে বলেন আরেক।” গভর্নর নিজেই মাত্র ১৪-১৫ মাস আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাহলে তিনিই কি দেশের অর্থনীতিকে টানেলে ঢুকানোর বন্দোবস্ত করে এখন গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক যেমন আমদানি, রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশের সঙ্গে দায়স্থিতি সবই বর্তমানে শ্লথ, অথবা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। এগুলোর অনেকগুলোই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাহলে কী আমাদের ধরে নেয়া উচিত যে অর্থনীতির বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য তিনি পুরো না হলেও অন্তত কিয়দাংশে দায়ী অথবা তার ব্যর্থতার ফলাফল। এক কথায় তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।

তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন দীর্ঘদিন সুদের হার ৬ ও ৯ শতাংশ করে রেখেছেন। অর্থাৎ ব্যাংকে জমা রাখলে সুদ দেবে ৬ শতাংশ। ঋণ দিলে ব্যাংক পাবে ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ অথচ জমাকৃত টাকার উপর সুদ পাবেন ৬ শতাংশ। তাতে দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে গেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এরকম বৈচিত্র্যময়, বিপরীতমুখী ও বাধা-ধরা নীতি পৃথিবীর অন্য দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। তখন কেউ কোনো বাধা দেয়নি। কারণ এই চালক-পরিচালকেরা সবাই দলীয় সরকারের পদাবলী বা ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। তার আগে গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন যিনি, তিনি তার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। একে বলা যায় নতুন ধরনের সিন্ডিকেট। যারা একত্রে মিলে মিশে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসর মুখে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। এখন তিনি টানেলে আলো দেখছেন। নাকি দেশকে অর্থনীতির আরও অতল গহব্বরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আঁকছেন, সেটা অচিরেই বোঝা যাবে। তবে এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এসব দলীয় লোকজন সিন্ডিকেট বানিয়ে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে, এক ধরনের দলীয় সংগঠনে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান এখন বস্তুত অকার্যকর। এসব প্রতিষ্ঠান জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন অকল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

(চলবে)
লেখক: সাবেক সভাপতি এফবিসিসিআই, কৃষি অর্থনীতিবিদ।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!