DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

কুয়েতে অভিযুক্ত এমপি পাপুলের পক্ষে সাফাই গেয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  কুয়েতে সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার মানবপাচারে অভিযুক্ত বাংলাদেশি এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে নির্দোষ বলে সাফাই গেয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত এস.এম. আবুল কালাম।

চলতি বছরের ১৯শে ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে দেয়া এক চিঠিতে তিনি এই এমপির বিষয়ে অনেকটা ইতিবাচক অবস্থান নেন। আমাদের এর হাতে আসা ওই চিঠির  স্মারক নম্বর কুয়েত/প্রশাসন / বিবিধ-১/২০২০।

এর আগে কুয়েতে মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত ওই এমপিকে বাংলাদেশের মানবপাচারকারী উল্লেখ করে দেশটির কয়েকটি গণমাধ্যম  সংবাদ প্রকাশ করে। এই সংবাদে দুই দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শুরুতে ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশী এমপি পাপুলের নেতৃত্বাধীন চক্রটি অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে।

 

ওই মাসের ১০ তারিখ  কুয়েতের আরবি দৈনিক আল কাবাস ও আরব টাইমস সংসদ সদস্যসহ বাংলাদেশের মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরের দিন ১১ই ফেব্রুয়ারি আরব টাইমসের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কুয়েতে জনশক্তি রপ্তানির জন্য সরকারি কার্যাদেশ পেতে ঘুষ হিসেবে সেখানকার সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি দিয়েছেন ওই বাংলাদেশী এমপি।

এই সংসদ সদস্য তার সম্পদের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে সেখানকার এক নাগরিকের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে ব্যবসা শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি শ্রমিকদের যে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কুয়েতে কাজ দেয়ার কথা, সেই সুযোগ সুবিধা ভঙ্গ করে তার কোম্পানি। এমন সংবাদ  প্রকাশ হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে ঢাকা। এই ঘটনার আট দিন পর পররাষ্ট্র  প্রতিমন্ত্রীকে এমপির পাপুলের পক্ষে সাফাই গেয়ে কুয়েতে দায়িত্বরত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম একটি চিঠি দেন।

চিঠিতে লক্ষীপুর-২ আসনের ওই এমপির পক্ষ নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, কুয়েতের আরবি দৈনিক আল কাবাস পত্রিকায়  প্রকাশিত সংবাদটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। সংবাদে উল্লেখিত বিষয় সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য পত্রিকাটির সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে আমার অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। আমি তার কাছে প্রশ্ন করি, প্রকাশিত সংবাদে আপনি কুয়েতে ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রির তদন্তের কথা লিখেছেন। এ ব্যাপারে আপনার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কী? উত্তরে তিনি বলেন, আমি লোকজনের কাছে শুনেছি। রাষ্ট্রদূত বলেন,আমি সংসদ সদস্যসহ উল্লেখিত তিনজনের নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তরে সে বলে, তারা পত্রিকায় সংসদ সদস্যেরে নাম উল্লেখ করেনি। এবং তার নাম সে জানে না, লোক মুখে শুনেই সে লিখেছে।

ওই চিঠিতে রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, অবৈধভাবে এক দেশ হতে আরেক দেশে  লোক নিলে সেটাকে মানবপাচার বলা হয়। কুয়েতে বাংলাদেশে এভাবে লোক এসেছে কিনা জানতে চাইলে ওই রিপোর্টার বলেছেন, কোম্পানিগুলো হাজার হাজার লোক বাংলাদেশ থেকে এনেছে। বাংলাদেশ থেকে লোক আনতে কুয়েত সরকারের লামানা (এনওসি) এবং ভিসার প্রয়োজন হয়। কোম্পানিগুলো এনওসি ও ভিসার মাধ্যমে লোক আনয়ন করছে। এটা মানবপাচার হয় কী করে এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রদূতের ভাষ্যে, ওই রিপোর্টার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। রাষ্ট্রদূত বলছেন, এতেই বোঝা যায়, প্রকাশিত সংবাদটি মিথ্যা ও বানোয়াট  এবং কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে  প্রকাশ করেছেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে দেয়া ওই চিঠির তিন নাম্বার পয়েন্টে রাষ্ট্রদূত বলেন, কুয়েতে কোনো প্রবাসীর বিরুদ্ধে মামলা হলে কুয়েত সরকার তার দেশ ত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আবার বাইরে থেকে কুয়েতে  প্রবেশের সময়  গ্রেপ্তার করে। মাননীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম পাপুল  বাংলাদেশ থেকে কুয়েত প্রবেশকালে এধরনের অবস্থার সম্মুখীন হননি। গত এক সপ্তাহ ধরে (ফেব্রুয়ারি মাসে) কুয়েত তিনি স্বাভাবিক চলাফেরা করছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছেন। অপরপক্ষে জনাব শহীদুল ইসলাম পাপুল এমপি কে কুয়েত জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অব ক্রিমিনাল এভিডেন্স থেকে ‘গুড কনডাক্ট সার্টিফিকেট’ প্রদান করেছে। পাপুল  কুয়েত মিনিস্ট্রি অব ইন্টেরিয়রের ক্রিমিনাল এভিডেন্স ডিপার্টমেন্ট থেকে‘ নট কনভিক্টেট’ প্রত্যয়ন আমাদের নিকট প্রদান করেছেন। গ্রেপ্তারের আগে পাপুলকে নির্দোষ দাবি করে রাষ্ট্রদূত ‘গুড কনডাক্ট সার্টিফিকেট, নট কনভিক্টেট’ এই দুইটি সনদের কথা দাবি করেন এই চিঠিতে। 

শুধু তাই নয় রাষ্ট্রদূত আবুল কালাম ওই চিঠিতে বলেন, আমরাও কুয়েত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহে অনুসন্ধান করে দৈনিক আল কাবাস পত্রিকায়  প্রকাশিত  এ ধরনের   কোনো বিষয়ে মামলার  খোঁজ পাইনি । যদিও রাষ্ট্রদূত বরাবর ঢাকাকে জানিয়ে আসছেন, কুয়েত সরকার তাকে কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। সবশেষ তিনি বলেছেন, ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দৈনিক আল কাবাসের সূত্র ধরে অন্যান্য পত্রিকায়  প্রকাশিত সংবাদসমূহ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

প্রতিমন্ত্রীকে  দেয়া রাষ্ট্রদূতের এমন চিঠির বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চিঠি একজন অপরাধীর পক্ষে পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ঢাকাকে ভুল বোঝানো ছাড়া কিছুই নয়। এছাড়া বাংলাদেশের সংসদ সদস্য মানবপাচার ও অর্থপাচারের অপরাধে কুয়েত সরকার গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে কয়েকদিন হলো। রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে প্রতিদিন দেশটির গণমাধ্যমে খবর আসছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত। শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকাকে কিছুই জানাতে পারেনি তিনি। এছাড়া কুয়েতে বাংলাদেশি দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত আছে বলেও দেশটির গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছেন। এমন সংবাদ যখন কুয়েতি গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে তখন, কুয়েতি বাংলাদেশি প্রবাসীরা কুয়েত দূতাবাস নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানান তথ্য দিতে থাকেন, এতে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে গত ১৩ই জুন কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কুয়েতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জড়িয়ে মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য  প্রচার করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা  নেয়া হবে বলে এক ভিডিও বার্তায় হুঁশিয়ারি দেন রাষ্ট্রদূত। সেখানেও তিনি বলেন ,‘দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে ফেসবুকে যেসব তথ্য  দেয়া হচ্ছে, তা মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে ওই সংসদ সদস্যের সঙ্গে কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের ঘনিষ্ঠতা  রয়েছে।

এদিকে চিঠির বিষয়ে কুয়েতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এস.এম. আবুল কালামের সঙ্গে  হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি চিঠির সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, চিঠিতেই আমি বিস্তারিত বলেছি। এরচেয়ে  বেশি কিছু বলার নেই।  তিনি জানান, কুয়েত সরকার তাকে  কোনো তথ্য দিচ্ছে না। প্রশ্নছিলো তথ্য না দিলে চিঠিতে উল্লেখিত তথ্যগুলো তিনি  পেয়েছেন  কোথায়, এই  প্রশ্নে তিনি  কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কুয়েতে সরকার তথ্য না  দেয়ার ব্যাপারে তিনি  কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমপির সঙ্গে সখ্যতার ব্যাপারটাও নাকোচ করে দেন তিনি।

দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে কুয়েতি গণমাধ্যম খবরের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের কাছে  কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া সরকার আমাদের কিছু জানাচ্ছে না। কর্মচারী জড়িত এই সেই, এগুলো মুখরোচক কথা। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। চিঠির বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে দুই দিন ধরে মোবাইল ফোনে ও এসএমএস এ যোগাযোগ করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন  বলেন, আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূতকে বলেছি সঠিক তথ্য জেনে আমাদের জানানোর জন্য। ওনি আমাদের বলেছেন, কুয়েত সরকারকে নোট ভার্বাল দিয়েছেন আমাদের সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য। কিন্তু কুয়েত সরকার সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন, ওরা লকডাউনে আছে, কারো  ফোন ধরছে না বা কারো সঙ্গে দেখা করছে না। আমরা একটি স্ট্যান্ডিং অর্ডার দিয়ে রেখেছি, কুয়েত সরকার যা বলে আমাদের জানানোর জন্য। কুয়েত সরকারের তথ্যমতে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!