DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকাঃ সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

 

 ড.সায়ন্থ সাখাওয়াৎঃ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ছিল গণমুখী। সেই সব ঐতিহাসিক সময় সৃষ্টি করে গেছে কিছু ঐতিহাসিক সাংবাদিককে। যারা স্বমহিমায় আজও উজ্জল।  তাদের পেশাদারিত্ব, সততা, দেশপ্রেম ও সাহস আজও অনুকরণীয়। তাদের আজও স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। কিন্তু সেই ধারা কি আমাদের গণমাধ্যম ধরে রাখতে পেরেছে?

২০০১ সাল। তখন কাজ করি শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে। সে বছর ১ অক্টোবরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের এক মাস জুড়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় সাতটি পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে একটি সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সেই সমীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে লেখা আর্টিকেলটি কভার স্টোরি হিসেবে ছাপা হয়েছিল ১৬ আক্টোবর সংখ্যা যায়যায়দিনে। প্রতিবেদনের শুরুতেই লিখেছিলাম, ‘এই মুহূর্তে যদি একটি জরিপ চালানো হয় যে, কোন কোন পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানুষ ভয় পায়, মনে মনে ঘৃণা করে এবং সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে? এর উত্তরে আর যাই আসুক না কেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও পুলিশের নাম যে তালিকার শীর্ষ ভাগেই থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। মানুষের কাছে বিশ্বস্ত, শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রকৃত বন্ধুর অবস্থানে থাকার কথা এদের। বিশেষত সাংবাদিকতার মতো একটা মহৎ সৃজনশীল কাজের প্রতি সবারই শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ ছিল।’

 

প্রায় দেড়যুগ পরে এসে এই কথাগুলোর প্রেক্ষাপটে কি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? এটা সত্য যে এখনো সৎ পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই পেশাদারিত্বের সঙ্গে সাংবাদিকতা করার সুযোগ কমই পেয়ে থাকেন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা ‘সাংবাদিকতা’ না করে সাংবাদিকের ‘চাকরি’ করতে বাধ্য হন।  সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। তখনকার প্রিন্ট মিডিয়ার সেই একচ্ছত্র আধিপত্যের জায়গায় যোগ হয়েছে প্রায় তিন ডজন বেসরকারি টেলিভিশন। বেড়েছে রেডিওর সংখ্যাও। অদৃশ্য ও দৃশ্যমান মহলের হাতে নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ও টেলিভিশনের বাইরে যোগ হয়েছে অপ্রতিরোধ্য  সোশ্যাল মিডিয়া। একদিকে সংবাদমাধ্যম ও তার কর্মীর সংখ্যাও যেমন বেড়েছে বহুগুণ। অন্যদিকে যেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর  প্রতিযোগিতায়ও একটাকে পরাজিত করছে আরেকটা মিডিয়া।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলোর এভাবে রাজনৈতিক দলের দিকে হেলেপড়া বা মিশে যাওয়ার কারণ কী? উত্তর খুব সোজা। এর পেছনের মানুষগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত। পেশাদারিত্ব থেকেও তাদের কারও কারও বেলায় দলদাস হওয়ার প্রবণতা বেশি। দেশের নষ্ট রাজনীতির  ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ও  হালুয়া-রুটির ভাগ-বাটোয়ারার প্রতি কিছু সাংবাদিকের আকর্ষণও এ অবস্থার জন্য দায়ী। সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন ও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সাংবাদিক সংগঠনগুলোই বলে দেয় সাংবাদিকরা কতটা বিভাজিত।

 

এ ‘নির্বাচনে’ কী প্রক্রিয়ায় কতটা কী হয়েছে তা জানার জন্য কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক বা সিপিডির রায়ের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি কারও। সকল মতের পথের পেশার সব প্রায় সব মানুষ জানেন এ নির্বাচনে কী ঘটেছে।  কিন্ত তার প্রতিফলন কি এ দেশের সংবাদমাধ্যমের কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে? কেন আসেনি? নিশ্চয়ই আমাদের সাংবাদিকরা সক্ষমতায় এতটা পিছিয়ে নেই। একদিকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বাড়াবাড়ি রকমের কড়াকড়ি অন্যদিকে কিছু সাংবাদিকের রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ থাকেন ভীত। তারা সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে চান না। কেউ মুখিয়ে থাকেন সরকারি সুস্বাদু হালুয়া-রুটির জন্য। এই যে একটা ‘লাভলি’ ইলেকশন হয়ে গেল যাতে ‘ফেয়ার’-এর ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাতে ম্যাক্সিমাম মিডিয়া কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে? তাদের ভূমিকা কি জনমুখী নাকি দলমুখী ছিল? তাদের ভূমিকা কি দেশের গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে এগিয়ে নিতে যথাযথ ভূমিকা রেখেছে? নির্বাচনপূর্ব কয়েকটি নমুনা দেখে নেওয়া যাক।

একজন সাংবাদিক প্রবীণ আইনজীবী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনকে যে পরিবেশে যে ধরনের  প্রশ্ন করেছেন তা কি ন্যায়সঙ্গত ছিল? তার জবাবে ড. কামাল হোসেন ‘খামোশ’ বলে ও দেখে নেওয়ার কথা বলে যে অনুচিত কাজটি করেছিলেন সে জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুল স্বীকার করেও রেহাই পাননি। ওই সাংবাদিকের প্রশ্নকে জাস্টিফাই করার জন্য অনেকেই তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন।

 

কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আরেকটি জোটের প্রধানকে ওই সাংবাদিক কখনো এই প্রশ্ন করেছেন বা করতে পারবেন যে ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে যে ‘টেকনিক্যাল এলায়েন্স’ করেছিলেন সে জন্য জাতির কাছে কি ক্ষমা চাইবেন? অথবা পতিত স্বৈরশাসকের সঙ্গে জোট করে আবার যখন তারা ‘নূর হোসেন দিবস’ পালন করেন, তখন কি কোনো সাংবাদিক মহাজোট প্রধানকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখেন যে আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নাকি নূর হোসেনের আত্মত্যাগ?

নির্বাচনের আগে আগে একটি টিভি চ্যানেল অনলাইন জরিপের ফল পাল্টে দিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ড. কামাল হোসেন তাকে প্রশ্ন করায় ক্ষুব্ধ হয়ে একজন সাংবাদিককে ‘খামোশ’ ও দেখে নেওয়ার কথা বলে তিনি ঠিক কাজ করেছেন কি না সেটি ছিল সেই জরিপের বিষয়। তাতে ৩০ হাজার ভোটের মধ্যে যখন ড. কামালের পক্ষে ৮১ শতাংশ ও  বিপক্ষে ১৯ রায় যায় তখনই টনক নড়ে চ্যানেলটির। তারা তৎক্ষণাৎ ফল পাল্টে ড. কামালকে পরাজিত করে ৪৪ শতাংশ ভোট দেয়! বিপক্ষে দেয় ৫৬ শতাংশ। কিন্তু অনলাইন ভোটাররাও কম যায় না। তারা টাইম টু টাইম ধরে রাখে ভোটের ফলাফলের স্ক্রিনশট! ফলে ধরা পড়ে যায় জালিয়াতি! এ বিষয়ে চ্যানেলটি কোনো ব্যাখ্যা পর্যন্ত দেয়নি!

একটি টিভি চ্যানেল প্রার্থী পরিচিতিতে একদিকে লিখল ‘আওয়ামী জোটের প্রার্থী’ অন্যদিকে লিখল ‘বিএনপি-জামায়াত জোটপ্রার্থী’। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ‘ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এটা তো সবারই জানা। এর নাম কি সাংবাদিকতা?

 

অনুগত, তবুও নিয়ন্ত্রণ, তবুও কালো আইন! এত ভিজিবল ও গায়েবি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পত্রিকা, টিভি ও রেডিওতে স্বাধীন মত প্রকাশ সত্যিই দুরূহ। তাই বহু মানুষের এখন মত প্রকাশ ও ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যদিও সেখানেও গুজব ও ফেক নিউজ থেকে সত্যটাকে আলাদা করে গ্রহণ করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য। সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরকারের পক্ষপাতমূলক নজরদারির বাইরে থাকেনি। পক্ষে হলে ষোল খুন মাফ। কিন্তু ভিন্নমতের হলে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য জেল-জুলুম থেকে রেহাই পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, লেখক, ব্লগার, অভিনেত্রী এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম পর্যন্ত। স্ট্যাটাসে লাইক দেওয়ার জন্য সাংবাদিককে পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দমন-পীড়নেও তুষ্ট হতে না পেরে সরকার একাধিকবার ফেইসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোবাইল ডাটা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সমগ্র মোবাইল গ্রাহকদের।

সরকারের এইসব নানামুখী নিপীড়নের বিষয়েও সাংবাদিকরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন করেও তা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে সরকার। কিন্তু কোনো সরকারই যে সব সময় সকল সাংবাদিকের প্রতি বন্ধুসুলভ থাকে না, যে কোনো সময় যে কেউ হতে পারেন অন্যায় আক্রমণের শিকারÑ এ কথাটা উপলব্ধি করে যত দ্রুত সরকারের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করবে, সমালোচনা করবে, ততই মঙ্গল। এমনকি চরম অনৈতিক ও জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনেরও।

লেখকঃ ড.সায়ন্থ সাখাওয়াৎ,

বিশিষ্ট গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, চিকিৎসক ও কলামিস্ট।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!