DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

গত ১বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা পাচারঃজিএফআই

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) মঙ্গলবার এই বিপুল অর্থ পাচারের  তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থপাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়তই এটা ঘটছে যা দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য হুমকি। সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে অর্থপাচার রোধ সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা মোটেও ভালো সংবাদ নয়, এটা দুঃসংবাদ। এসব টাকা পাচার হয়ে যাওয়া মানে উন্নয়নের জন্য দুঃসংবাদ। আর সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। ঘটনাগুলো ঘটছে, বিভিন্ন আইন আছে, সংস্থা আছে। তাদের যে নজরদারি, কর্মদক্ষতা সেটার ঘাটতি আছে। এসব ঘটছে অথচ আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছি না। করব, করছি এই টাইপের বিষয়গুলো দুঃখজনক।
বিচারহীনতার কারণে অর্থপাচারে ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমরা দেখছি কারা করছে, কিছু তথ্য আসছে কিছু আসছে না। কিন্তু ফলোআপ হচ্ছে না। মানুষ তো অনেক কিছুই জানে না কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না, তদন্ত হচ্ছে কি না। অথচ অন্যান্য দেশের দিকে যদি আমরা দেখি, পার্শ্ববর্তী ভারতে যদি দেখি পানামা পেপারস নিয়ে হৈ চৈ হয়েছে তাদের বিষয়ে তথ্য চাচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে কোনো কথাই শুনতে পাইনি। অর্থাৎ এগুলো করে যখন লোকজন দেখে কোনো কিছুই হয় না। শুধু সংবাদ ছাপা হয় আর লোকজন উৎসাহ পেয়ে যায়। নতুন লোকজন তারাও ভাবে। এই দুটো জিনিস খুব দুঃখজনক।


অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব সম্পর্কে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার চাইলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস কীভাবে রোধ করা যায়, তা সাজেশন দিতে পারে। আমাদের নজরদারি ব্যর্থতা রয়েছে। ধরা পড়ার পর, জানার পরও যে যথাযথ দৃশ্যমান দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেগুলোর ব্যাপারে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।


বিচারহীনতাকে অর্থপাচারের মূল কারণ উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জিএফআইয়ের রিপোর্টে যে তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক এবং এতে আমি অবাক হই না। কারণ, এ ধরনের সমস্যা যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে হতে থাকে তখন তা সম্প্রসারণ হওয়া স্বাভাবিক। যারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা যখন বিচারহীনতার মধ্যে থাকে তখন এটা অবাক হওয়ার কিছু না।
অর্থপাচারের দুটো দিক আছে। একটা সরবরাহের দিক আরেকটা চাহিদার দিক। সরবরাহকারী হচ্ছে আমরা। আমাদের দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। আর চাহিদাটা হচ্ছে যেসব দেশে যাচ্ছে। এটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। এসব দেশের আইনি কাঠামো পাচারের জন্য সহজ। এ চাহিদার দিকেও কাজ করতে হবে।


টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, যে অনিয়মের মাধ্যমে বাইরের দেশে সরবরাহ করা হয় সেটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের। চাহিদা আছে বলেই আমরা সরবরাহ করব, এটা হতে পারে না। নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে কোনো জায়গাটায় সুযোগটা তৈরি হচ্ছে। যারা আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত তারাই বিল কম-বেশি করার মাধ্যমে এটা করছে। এটা প্রায় ৯০ শতাংশের মতো। কাজেই এই জায়গাটাতে হাত দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। তবে প্রথমেই রাজনৈতিক অঙ্গিকারের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, যারা এসব বড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। কাজেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।


নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা পালনের ওপর জোর দিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন ও এটর্নি জেনারেলের অফিস যদি যৌথভাবে কৌশলে কাজ করে এবং সরবরাহকারী দেশ ও চাহিদাকারী দেশের সঙ্গে আইনি-সহায়তা চুক্তি করে  তাহলে অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এটা কঠিন, জটিল, কিন্তু অসম্ভব না। অনেক দেশ করেছে এবং আমাদের দেশেও হয়েছে। কাজেই এটা জোরালোভাবে কেন হবে না- সেটাই প্রশ্ন আমাদের সামনে।


এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ব্যাপকভাবে পত্রপত্রিকায় প্রতিফলিত হয়েছে। এটার সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা, যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। যে অঙ্কটি বলেছে, সেটা অনেক বড় অঙ্ক। সংগঠনটি খুব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবুও আমি বলব যে দেশ থেকে টাকা পাচার হয় না এটা বলা যাবে না। টাকা পাচার হতে পারে। তবে ফিগারটা বড় না ছোট সেটা বিতর্ক হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, উন্নত-অনুন্নত সব দেশ থেকে টাকা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায় গোপনভাবে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাইরে যায়, চীন থেকে বাইরে যায়, মালয়েশিয়া, ভারত থেকে বাইরে যায়। এটি কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে। তবে পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক আছে। যা হোক এটা বন্ধ করতে হবে। এটি অবৈধ। বন্ধ করার পদক্ষেপ এনবিআরকে অবশ্যই নিতে হবে। অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। অবৈধ অর্থসম্পদের তথ্য বিনিময়ের চুক্তি আছে। কাজেই সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়ার বা কানাডার বেগমপাড়ায় টাকা গেলে তা বের করা কঠিন হবে না। আজকাল ধরে ফেলা যায়।


ব্যবসায়ীদের দেশেই টাকা বিনিয়োগে উৎসাহিত করার বিষয়েও জোর দেন পরিকল্পনা কমিশনের এ সদস্য। তিনি বলেন, আমাদের দেশের টাকা দেশেই বিনিয়োগ করতে হবে। দেশে যথেষ্ট বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য। সরকার যথেষ্ট সুযোগ দিচ্ছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। জ্বালানি ও অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কাজেই তাদের দেশেই বিনিয়োগ করা উচিত। এদিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ধরে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।


জিএফআই আট বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে আসছে। এবারের প্রতিবেদনে রয়েছে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এগুলো হলো, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।


প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হয়ে গেছে, তা চলতি অর্থবছরের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার সমান। চলতি বাজেটে মূসক থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। আর নতুন মূসক আইন নিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের চলছে বড় ধরনের টানাপোড়েন। সুতরাং কেবল অর্থ পাচার ঠেকাতে পারলেই মূসক খাতের আয় নিয়ে আদৌ কোনো দুশ্চিন্তা করতে হতো না এনবিআরকে। তা ছাড়া এই অর্থ চলতি অর্থবছরের পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানিসম্পদ খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান।


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায় দুই অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে পারতেন।


গবেষণা পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে জিএফআই এবারের প্রতিবেদনে গত ১০ বছরের বছরওয়ারি হিসাব আলাদা প্রকাশ করেনি। ফলে আগের বছরের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ‘উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ২০০৪-১৩’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশিত করছিল।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচারের তথ্য ছিল। টাকার অঙ্কে যা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর সব মিলিয়ে ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
মূল প্রতিবেদনে ১৪৯টি দেশের অবৈধ অর্থ প্রবাহের তথ্য দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার ২৪ শতাংশই হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে। আর প্রতি বছরই অর্থ পাচারের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০১৪ সালে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ থেকে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। মূলত আর্থিক খাতে স্বচ্ছতার অভাবেই অর্থ পাচার বাড়ছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!