DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিদেশে অর্থ পাচারঃআবার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ !

bangflag copy

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে আবারও আন্তর্জাতিকভাবে ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশ’-এর তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

এপিজি হচ্ছে ‘অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন’ বিষয়ে মানদণ্ড নির্ধারণকারী এশিয়া অঞ্চলের সংস্থা। এপিজির তৃতীয় পর্বের খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন-সংক্রান্ত ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ একটি বাদে বাকি সবগুলোতে নিম্ন ও মধ্যম মানে রয়েছে।

দুই বছর আগে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু আগামী জুলাইয়ের মূল্যায়নে তা বদলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ‘মান অবনতি’ ঘটার এই আশঙ্কার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)।

মূলত আইনকানুন তৈরিতে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও এর বাস্তবায়ন করতে পারছে না। আর এ কারণেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশ’ হওয়ার হুমকিতে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, অর্থ পাচার নিয়ে বাংলাদেশ আইন করলেও তা কমছে না, বরং বাড়ছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা টাকার অঙ্কে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪০ কোটি। এই অর্থ চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের প্রায় দেড় গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আগামী জুলাইয়ে এপিজির বার্ষিক সভায় বাংলাদেশ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর এই সময়ের মধ্যে ন্যূনতম আরও দুটি মানদণ্ডে উন্নতি করতে পারলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে না বাংলাদেশকে।

ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তার সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যদি বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় চলে যায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও অভ্যন্তরীণ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদের হারও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১১টি মানদণ্ড রয়েছে। এই ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে যদি কোনো দেশ ৯ বা তার চেয়ে বেশি মানদণ্ডে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপভুক্ত (আইসিআরজি) হবে।

আর যদি কোনো দেশ ৮ বা তার কম মানদণ্ডে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে দেশটি বিশ্বজনীন আন্তসরকার সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদণ্ড পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকায় চলে যায়।

যে ১০টি মানদণ্ডে বাংলাদেশ খারাপ অবস্থানে রয়েছে, তার মধ্যে ২ নম্বর মানদণ্ডে বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে।

এই মানদণ্ডের মান নির্ণয়ে বিবেচ্য বিষয় হলো আন্তর্জাতিকভাবে সঠিক তথ্য আদান-প্রদান, আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম, সন্ত্রাসী ও তাদের সম্পদের বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই মানদণ্ডে বর্তমান বাংলাদেশ ‘মধ্যম’ মানে রয়েছে।

একই মানে (মধ্যম) থাকা ৬ নম্বর মানদণ্ডেও উন্নতির সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। এই মানদণ্ডের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আর্থিক গোয়েন্দাগিরি ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো ‘অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন’ রোধে কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়, তার ভিত্তিতে।

বাংলাদেশ ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইসিআরজি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এফএটিএফ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতও এফএটিএফভুক্ত দেশ। তবে পাকিস্তান অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত নয়। প্রচলিত সাধারণ নিয়মে বিশ্বের কোনো দেশ আইসিআরজি প্রক্রিয়াভুক্ত থাকলে আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই দেশটির ঋণপত্র বা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খরচ বেড়ে যায়।

এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এপিজির মূল্যায়নে যে একটি মানদণ্ডে বাংলাদেশ শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে, সেটি সম্ভব হয়েছে মূলত ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশকারী জাতিসংঘের নিরাপত্তাবিষয়ক কাউন্সিলের কালো তালিকাভুক্ত উত্তর কোরিয়ার ওশান মেরিটাইম ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ‘এমভি ঝংডি ওয়ান’ নামে এক জাহাজকে আটকে দেওয়ায়।

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এটিই অন্যতম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। উত্তর কোরিয়ার ওশান মেরিটাইম ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটির একটি জাহাজে করে ২০১৩ সালে চিনি পরিবহনের নামে মিগ-২১ নামের ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন করা হয়।

পরে তা ধরা পড়লে প্রতিষ্ঠানটিকে আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তাবিষয়ক কাউন্সিল। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়, তদারকি, এ-সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানসহ সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করে থাকে বিএফআইইউ।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়। এগমন্ট গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বা ইউনিটগুলোর একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যেখানে বাংলাদেশের হয়ে যুক্ত আছে বিএফআইইউ। এদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের বর্তমান মান ধরে রাখতে বিএফআইইউ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ‘মান উন্নয়নে’ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য অন্তত দুটি ইমিডিয়েট আউটকাম (আইও) বা ত্বরিত ফলাফলে শক্তিশালী শ্রেণিতে (ক্যাটাগরি) উন্নতি ঘটাতে হবে।

জানতে চাইলে বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, ‘আইনকানুনে আমরা এগিয়ে থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে বলে জানিয়েছে এপিজি। তবে সেসব সমস্যায় উন্নতি করার জন্য আমরা জুলাই পর্যন্ত সময় পাব। আশা করছি, তার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি ঘটবে না।’

দেবপ্রসাদ দেবনাথ আরও জানান, ‘গত অক্টোবরে এপিজির একটি দল বাংলাদেশ সফরে এসে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখে। সেই সফরের প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তারা তৃতীয় পর্বের খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সেখানে তারা যেসব সমস্যার কথা বলেছে, সেগুলোর বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরছি।’ এদিকে বাংলাদেশের ‘মান অবনতি’ ঘটার আশঙ্কার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বিএফআইইউ।

গত ২৩ মার্চ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, কারিগরি কর্মপন্থায় (টেকনিক্যাল কমপ্লায়েন্স) ভালো করলেও বাস্তবায়ন বা প্রায়োগিক দিক থেকে বাংলাদেশের মান আশানুরূপ নয়।

এপিজির খসড়া মূল্যায়নে ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশ একটিতে শক্তিশালী, পাঁচটিতে মধ্যম ও পাঁচটিতে নিম্ন মানভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে ১০টিতে নিম্ন ও মধ্যম মানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে বাংলাদেশ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য মধ্যম মানপ্রাপ্ত দুটি মানদণ্ডে ‘শক্তিশালী’ অবস্থান নিশ্চিত করার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সংক্রান্ত যে ঝুঁকি নিরূপণ প্রতিবেদন ও কৌশলপত্র তৈরি করেছে, তাতে সন্ত্রাসে অর্থায়নকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি বলে জানিয়েছে এপিজি। এমনকি এ বিষয়ে বাংলাদেশের দালিলিক কোনো কৌশলপত্র নেই বলেও এপিজি তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!