DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

এবার চট্টগ্রামে ‘কালো বিড়াল’

1413602754সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি থেকে উদ্ধার করা ৭৫ লাখ টাকার ঘটনার পর আরও একটি আলোচিত ঘটনার জন্ম হলো চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায়।

আর ঘটনাটি হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের টক অব দ্য টাউন। মো. ইলিয়াছ নামের এক যুবকের হাত দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ব্যাগভর্তি ৫৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। দুর্ভাগ্য এ টাকা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই চলে গেল পুলিশের হাতে।

তবে যার মাধ্যমে জন্ম নিল এ আলোচিত ঘটনার, টাকার গন্তব্যস্থল সম্পর্কে মুখ খুলতে চাইছেন না তিনি। ফলে এখনও জানা যাচ্ছে না নতুন এ কালো বিড়ালটি কে? সাধারণ মানুষের কৌতূহল টাকাটা কি ঘুষের ছিল?



আদালতের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনায় দিনদুপুরে বস্তাভর্তি এত টাকা কীভাবে এলো, কী কাজের জন্য এত টাকা ঘুষ? কাকে দেয়া হবে বা কার জন্য ও কেন নিয়ে যাচ্ছিল তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ ছিল না সাধারণ মানুষের। ঘটনার পর থেকেই নগরীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালত ছাড়াও পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানেও এ বিষয়টি আলোচনার ঝড় তোলে। খুব আগ্রহ সহকারে একে অপরের কাছে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছেন— কার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল এ টাকা, নতুন কালো বিড়ালটি কে? 



এদিকে অভিযোগ উঠেছে— পুলিশের হাতে আটক ৫৮ লাখ টাকা আউটার রিং রোড প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা এক ব্যবসায়ীর জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদেয় টাকার বিপরীতে ঘুষের টাকা ছিল। জিয়া নামে ওই ব্যবসায়ী নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা। 



এ প্রসঙ্গে বর্তমানে নগরী ও জেলায় ৫০টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে এবং এসব প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে বলে জানালেন জেলা প্রশাসনের ভূমি হকুম দখল কর্মকর্তা ইউনিট-১-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তফাজ্জল হোসেন। 



জানা গেছে, চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের জন্য জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করেছে ২৩ দশমিক ৪৭ একর। এ জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। এলএ শাখা এ যাবত্ সংশ্লিষ্ট জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেছে ৫৭ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ২১৬ টাকা ৪৭ পয়সা।



টাকাসহ আটক ইলিয়াছ ভূঁইয়ার বক্তব্য: পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইলিয়াছ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মুরাদের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান। চিটাগাং আউটার রিং রোড প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা এক ব্যক্তির জমির ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ‘কমিশন’ হিসেবেই এ টাকা মুরাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন ইলিয়াছ। তার সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার শহীদুল ইসলাম ওরফে মুরাদের সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করে। টাকার উত্স সম্পর্কে বললেও টাকার গন্তব্যস্থল সম্পর্কে কিছুই বলেননি তিনি।



আদালত সূত্রে জানা যায়, ঘুষ কেলেঙ্কারিতে শীর্ষ এক কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় জেলা প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সকালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জেলা প্রশাসনের এলএ ও রেকর্ড শাখা পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) নেতৃত্বে দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় বদলি করা হয়েছে ১৩ জনকে। ঘটনার পর এলএ শাখাসহ বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে।

 

আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা উল্লেখ করে তদন্ত কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে তদন্তের কাজ শুরু করেছি। নিজের মতো করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ঘটনা ও ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ এবং তদন্ত করছি। প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।



কাকে কোথায় কোন শাখায় বদলি করা হলো: আদালতপাড়া থেকে ৫৮ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সার্ভেয়ার মুরাদ ও এক কর্মকর্তা জড়িত থাকার কথা ওঠায় এ পর্যন্ত ১০ সার্ভেয়ার ও তিন কানুনগোকে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।



জানা গেছে বদলিকৃত সার্ভেয়ারদের মধ্যে মোহাম্মদ নুর চৌধুরীকে রাঙামাটির লংগদু উপজেলা ভূমি অফিসে, মুজিবুর রহমানকে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম মুরাদকে ভূমি হুকুম দখল শাখা, বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, আনোয়ার হোসেনকে চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী ডিসি অফিসে, সুনীল কান্তি দেব মহাজনকে চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলা ভূমি অফিসে, এসএম নাদিমকে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম পাটোয়ারীকে চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা ভূমি অফিসে, আশীষ চৌধুরীকে কুমিল্লার সদর উপজেলা ভূমি অফিসে, ফেরদৌস খানকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসে, আবদুর রউফ চৌধুরীকে নোয়াখালীর সদর ভূমি অফিসে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া কানুনগো আবদুল কুদ্দুসকে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলা ভূমি অফিসে, সুশীল বিকাশ চাকমাকে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা ভূমি অফিসে ও রফিকুল ইসলামকে কুমিল্লায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন দৈনিক বর্তমানকে জানান, শুধু টাকা আটকের ঘটনা নয়, বদলি চলমান প্রক্রিয়া এবং কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে মুরাদসহ অন্যদের বদলি করা হয়। সার্ভেয়ার মুরাদের বিষয়ে আগেও দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি। এক মাস আগে তাকে বদলির জন্য বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়কে অনুরোধও করেছিলাম। মুরাদের সঙ্গে সার্ভেয়ার নুর চৌধুরী ও মুজিবুর রহমানকেও বদলি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

কে এই শহীদুল?



সার্ভেয়ার শহীদুল ইসলাম মুরাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা এলাকায়। টাকাসহ ধরা পড়া ইলিয়াছ সম্পর্কে তার খালাতো ভাই। তিন বছর আগে চান্দগাঁও ভূমি অফিস থেকে বদলি হয়ে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় আসেন সার্ভেয়ার মুরাদ। আগ্রাবাদ এলাকায় সপরিবারে থাকেন তিনি। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার বোমা মেরে চট্টগ্রাম আদালত ভবন উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক সদস্য।

চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী মানস কুমার দাশের মোবাইলে এ হুমকি দেয়। ঘটনার পরপরই চট্টগ্রাম আদালত ভবনে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় আদালতে আসা আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষসহ সর্বস্তরের লোকজনকে ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৫৭ লাখ ৯৩ হাজার নগদ টাকাসহ মো. ইলিয়াছকে আটক করে পুলিশ। উদ্ধার করা টাকা এই শাখার কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে দেয়ার জন্য যাচ্ছিল এমন অভিযোগ ওঠার পর বুধবার কানুনগো ও সার্ভেয়ারসহ ১৩ জনকে বিভিন্ন জেলায় তাত্ক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। আটক হওয়া মো. ইলিয়াছকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।

অন্যদিকে আসামিকে নিয়মিত মামলা না দিয়ে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং আসামির কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল জব্দ তালিকায় না রাখার জন্য চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার ওসি ও এসআইকে আগামী রবিবার কারণ দর্শানোর আদেশ দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম ফরিদুল আলম এ আদেশ দিয়েছেন। শোকজ দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম এবং ৫৮ লাখ টাকা উদ্ধার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা  এসআই মো. কামরুজ্জামান। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!