DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

যেভাবে খুন হলেন নারায়ণগঞ্জের সেই সাতজনঃ মেজর আরিফ যা বললেন

download (7)নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনের অপহরণ ও হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) আরিফ হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি ও র‌্যাবের আরেক কর্মকর্তা রানা মিলে সাতজনকে হত্যা করেন।

হত্যাকাণ্ডে তাঁদের সহযোগিতা করেন আরো ১৭-১৮ জন। গতকাল বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় এ জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। এতে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। জবানবন্দিতে মেজর (অব.) আরিফ আরো জানান, লে. কর্নেল তারেক সাঈদ পুরো কিলিং মিশন মনিটর করেন। এ ঘটনার কথা র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন ও নিম্নস্তরের কিছু কর্মকর্তাও জানতেন।

পুরো ঘটনায় কাউন্সিলর নূর হোসেনের মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ ছিল। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, গতকাল ভোরে আরিফ হোসেনকে আদালতে আনা হয়। বিকেল সাড়ে ৩টায় তাঁকে নেওয়া হয় কারাগারে। জবানবন্দিতে আরিফ সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে কিভাবে অপহরণ, হত্যা সব কিছু আদালতে বলেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘আরিফের দেওয়া ৩৭ পৃষ্ঠার জবানবন্দি থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে পুরো কিলিং মিশন তারেক সাঈদ নিজেই তদারকি করেছেন। যেভাবে সাতজনকে খুন করা হয়েছে তার রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন মেজর আরিফ। এ হত্যায় পরিকল্পনাকারীর একজন হয়ে তারেক সাঈদ কাজ করেছেন। জবানবন্দিতে বের হয়ে এসেছে, নূর হোসেনের হয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে কাজ করেছেন।

এ হত্যায় র‌্যাবেব উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্নপদস্থ কারা কারা জড়িত, তাও বের হয়ে এসেছে।’ সাখাওয়াত আরো বলেন, জবানবন্দিতে তারেক সাঈদের নাম প্রকাশ পেলেও তিনি এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। গত শুক্রবার যখন তারেক সাঈদকে আদালতে আনা হয় তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু আমরা কাগজে-কলমে দেখতে পেলাম তারেক সাঈদের বাবা কর্নেল থাকা অবস্থায় মানুষকে হয়রানি করতে ৩৭টি মামলা করেছেন। সেই ঘরের সন্তান তিনি। তিনি মিথ্যা বলেছেন। তিনি পেশাদার খুনি বলেই এত বড় কিলিং মিশন সম্পন্ন করেছেন। তাঁর পরিবারের দ্বারা বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। তিনি আরো বলেন, সব কিছু এখন প্রমাণিত। বাবা-মেয়ে দুজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী অপহরণ দেখে ফেলায় র‌্যাব কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন যে সাতজনকে র‌্যাব-১১ লেখা গাড়ি তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া সেভেন মার্ডারের ঘটনায় লাশের সঙ্গে র‌্যাবের ডালের বস্তা, রশি, ইট, রশি গিঁট দেওয়ার ধরন বলে দেয় এ হত্যার সঙ্গে তাঁরা জড়িত। এখন তারেক সাঈদকে ফের রিমান্ডে নিয়ে সব কিছু জানা দরকার। আদালত সূত্র জানায়, মেজর (অব.) আরিফ জবানবন্দিতে বলেছেন, ২৭ এপ্রিল দুপুর ২টার দিকে তিনি ও লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ময়লাস্তূপের কাছে প্যানেল মেয়র নজরুল, আইনজীবী চন্দন সরকারের দুটি প্রাইভেট কার থামিয়ে তাদের সাতজনকে র‌্যাবের গাড়িতে তোলেন। সেখানে আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল র‌্যাবের তিনটি গাড়ি।

nur_hossain_2নজরুল উঠতে না চাওয়ায় তাঁকে পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। তাঁদের গাড়িতে ওঠানোর পর একে একে প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। সাতজনকে কয়েক ঘণ্টা গাড়িতেই রাখা হয়। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিকল্পনা মতে কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষশূন্য করার জন্য নূর হোসেনকে ফোন দেন মেজর আরিফ।

গাড়ির ভেতরই অচেতন অবস্থায় প্রত্যেকের মাথা ও মুখমণ্ডল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। পরে গলা চেপে ধরার পর একে একে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় সাতজন। পরে সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের ঠিক করে রাখা নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে। লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথে নির্দিষ্ট স্থান থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই একে একে প্রতিটি লাশের সঙ্গে ইট বাঁধা হয়। একটি করে ফুটো করে দেওয়া হয় নাভির নিচে, যাতে গ্যাস বের হয়ে যায় এবং লাশ ভেসে না ওঠে।

তারপর শীতলক্ষ্যা নদীর নির্দিষ্ট স্থানে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় লে. কর্নেল তারেক সাঈদও অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন। লাশ ফেলে নৌ পুলিশ ফাঁড়ি-সংলগ্ন ঘাট দিয়ে উঠে শহরের ভেতর দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার পথে শহরের হাজীগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্টে তারেক সাঈদ পুলিশের মুখোমুখি হন। তিনি দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমরাও আপনাদের মতো ওদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছি। তখন পুলিশ আর কিছু বলেনি।

7-muder_8অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডে ফতুল্লা মডেল থানার এক কর্মকর্তার মুখোমুখি হন আরিফ। তাঁকে দেখে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আর কিছু বলেননি।’ জবানবন্দিতে আরিফ আরো বলেন, ‘সাত খুনের ঘটনা আমরা তিনজন ছাড়াও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন দু-একজন কর্মকর্তাও জানতেন। আর পুরো মিশনে কাউন্সিলর নূর হোসেনের মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করা ছিল।’ উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন।

 

পরদিন ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। ৩০ এপ্রিল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ওই সাতজনের মধ্যে ছয়জন এবং ১ মে সকালে বাকি একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!