DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

মাত্রাতিরিক্ত দলীয় নিয়োগে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে

 
download (8)সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রশাসনে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা মূলত পলিসি প্রণয়ন কিংবা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কাজ করে থাকেন। বেশিরভাগ ফাইল নিষ্পত্তি ও সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ারও যুগ্ম সচিবের থাকে।
 
অথচ যুগ্ম সচিবের বিধিগত এ মর্যাদা ও ক্ষমতা কিছুদিন থেকে ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে। এখন যুগ্ম সচিবদের অনেকে কাজ করেন আগের চেয়ারে উপসচিবের পদে, কেউ কেউ আবার কোনো জায়গা না পেয়ে একেবারে শাখা পর্যায়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। ওদিকে উপসচিবের অবস্থা তো আরও করুণ। বেশিরভাগ উপসচিব গত কয়েক বছর ধরে সুপারনিউমারি হিসেবে সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে বসে আছেন।


জানা গেছে, দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতিযোগ্য বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে শূন্যপদের বাইরে পদোন্নতি দিতে গিয়ে প্রশাসনে এ দূরাবস্থা দেখা দিয়েছে। সরকার এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছে। কেন না সময়মতো পদোন্নতি না দিলে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ বেড়ে যায়, আবার শূন্যপদের বাইরে পদোন্নতি দিতে গিয়ে একদিকে যেমন পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে প্রশাসনের স্বাভাবিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
 
এই সংকট নিরসনের উপায় কী জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদত হুসেইন  বলেন, এ সারির কর্মকর্তারা তো পদোন্নতি চেয়েছিলেন, মর্যাদা চাননি। ফলে এ রকম বেহাল অবস্থা তো হবেই। শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি দিলে আজ এ অবস্থা হতো না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ রকম অরাজকতা দেশে আজ কোনো সেক্টরে নেই? সর্বত্র বিরাজমান।
 
 তাই এ নিয়ে মন্তব্য করেও কোনো লাভ হবে না। কোথাও কোনো ডিসিপ্লিন নেই। ড. সাদত বলেন, শুধু সচিবালয়ে কেন- মাঠ প্রশাসনেও তো একই অবস্থা বিরাজ করছে। ডিসির চেয়ারে বহু যুগ্ম সচিব দীর্ঘ সময় কাজ করে যাচ্ছেন অবলিলায়। কিন্তু সেখানে তো উপসচিবের থাকার কথা। অথচ একজন যুগ্ম সচিবের পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলিসি প্রণয়নসহ অনেক বিষয়ে এ কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে এভাবে প্রশাসনের মৌলিক কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আর ডিসিশন মেকিং ভেঙে গেলে সেভাবে ডিসিশনও দেয়া যায় না।
 


তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত প্রশাসনে মোট যুগ্ম সচিবের সংখ্যা ৯১২ জন এবং উপসচিবের সংখ্যা ১ হাজার ৩০৪ জন, যা সৃষ্ট বা নির্ধারিত পদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। শূন্যপদের তুলনায় বেশি সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে ২১৬ কর্মকর্তাকে সংযুক্তি প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত রয়েছেন ১২৮ জন এবং ওএসডি আছেন ৫৭৫ জন। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন ২০৫ জন। সংযুক্ত রয়েছেন ১৪৮ জন। ওএসডি আছেন ৮১ জন।
 
এছাড়া উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা লিয়েন ও প্রেষণে দেশ-বিদেশে কর্মরত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ে ডিউটি পদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি যুগ্ম সচিবকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন সুপারনিউমারি এবং বাকিরা সব সংযুক্ত। গত বছর ১৮ জুলাই ও ১০ সেপ্টেম্বর দুদফায় প্রায় সোয়া চারশ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার পর অনেককে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আগের পদে বহাল রাখা হয়। সেভাবেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
 


প্রশাসন ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর এ রকম পদায়নের বিষয়ে এখানে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের চিত্র তুলে ধরা হল। খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৭টি উইংয়ে যুগ্ম সচিব থাকার কথা ৭ জন। অথচ কর্মরত রয়েছেন ২০ জন। আবার যুগ্ম সচিবের ডিউটি পদ পেয়েছেন মাত্র ৩ জন। যেমন- যুগ্ম সচিব (এপিডি), যুগ্ম সচিব (শৃংখলা) ও যুগ্ম সচিব (প্রশাসন)। যুগ্ম সচিব (প্রশিক্ষণ), যুগ্ম সচিব (সংস্কার ও গবেষণা), যুগ্ম সচিব (বিধি) এবং যুগ্ম সচিব (সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা) পদে কর্মরত রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। কেন না, পদোন্নতি পেলেও অনেক অতিরিক্ত সচিব পদ সংকটের কারণে ডিউটি পদ পাননি। ফলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বাকি ১৭ জন যুগ্ম সচিবকে কাজ করতে হচ্ছে উপসচিবের চেয়ারে।
 


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবের ডিউটি পদগুলোর মধ্যে দুইটি পদে (পুলিশ এবং আইন ও পরিকল্পনা) কর্মরত রয়েছেন দুজন অতিরিক্ত সচিব। ওদিকে যুগ্ম সচিব হওয়ার পরও সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে কাজ করছেন (পুলিশ-১, রাজনৈতিক-৪ ও প্রশাসন-৩ শাখা) ৩ জন কর্মকর্তা। এখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নথিতে নোট দেয়ার পর যুগ্ম সচিবকে মার্ক করেন। সচিবালয়ের ইতিহাসে এর কোনো পূর্ব নজির নেই। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নোট দেয়ার পর সিনিয়র সহকারী সচিবকে মার্ক করার কথা। এছাড়া এ মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের চেয়ারে দায়িত্ব পালন করছেন ৯ জন যুগ্ম সচিব।
 
ডেস্কগুলো হল উপসচিব-প্রশাসন, রাজ, পুলিশ, ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা, আইন, সীমান্ত, আনসার ও জেল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩৬টি শাখা কর্মকর্তার পদে বেশিরভাগ স্থানে সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব নেই। বসে আছেন উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। এরপরও আরও যুগ্ম সচিব পদায়ন দেয়া হচ্ছে। অথচ বসার জায়গা নেই।
 


স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবের ডিউটি পদ ৬টি থাকলেও এখানে যুগ্ম সচিব কর্মরত আছেন ১৮ জন। আবার যুগ্ম সচিবের ৩টি পদে আছেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ফলে ১৫ জন যুগ্ম সচিবের প্রাপ্য চেয়ার নেই। এছাড়া সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে কাজ করছেন ৪ জনর যুগ্ম সচিব। শাখাগুলো হল হাসপাতাল-৪, আইন, নির্মাণ ও পরিবার কল্যাণ।


যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগে যুগ্ম সচিবের ডিউটি পদ ৪টি। এর মধ্যে প্রশাসন উইংয়ে বসে আছেন অতিরিক্ত সচিব। ফলে ডিউটি পদ পেয়েছেন মাত্র ৩ জন। এর বাইরে ৪ জন যুগ্ম সচিব কাজ করছেন উপসচিবের চেয়ারে। এগুলো হল ঢাকা বিআরটি, ননগেজেটেড সংস্থাপন, আইসিটি, সমন্বয় ও প্রশিক্ষণ। এছাড়া সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে দায়িত্ব পালন করছেন ৩ জন। এ শাখাগুলো হল বিআরটিসি, তদন্ত ও শৃংখলা এবং আইন ও সংস্থা। এ মন্ত্রণালয়ে শুধু উপসচিব (প্রশাসন) শাখায় একজন উপসচিব ডিউটি পদে আছেন। বাকি উপসচিবের পদগুলোতে কাজ করছেন যুগ্ম সচিব।


শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের চেয়ারে বসে আছেন ৭ জন যুগ্ম সচিব। শাখাগুলো হল বাজেট, প্রশাসন, মাধ্যমিক, কলেজ, অডিট অ্যান্ড আইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়। আর যুগ্ম সচিব হয়েও মন্ত্রণালয়ের এমপিও শাখায় সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে বসে আছেন এক কর্মকর্তা।


গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবের ডিউটি পদ ৩টি। এর বিপরীতে যুগ্ম সচিব পোস্টিং দেয়া হয়েছে ১০ জন। ফলে অবশিষ্ট ৭ জন যুগ্ম সচিব কাজ করছেন উপসচিবের পদে। এর মধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন সংযুক্ত হিসেবে।


প্রসঙ্গত, একজন কর্মকর্তা উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হওয়ার পর তিনি সার্বক্ষণিক গাড়ি প্রাধিকারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি প্রাধিকার অর্জন করেন। তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপরিসর অফিস কক্ষ ও ব্যক্তিগত কিছু স্টাফ পেয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে পদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় যুগ্ম সচিব পদোন্নতি ও পোস্টিং দেয়ায় এসব প্রাধিকার অনেক ক্ষেত্রে মানা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে গাড়িও পাননি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!